অব্যয়
যে সকল শব্দ লিঙ্গ-বচন-পুরুষ- বিভক্তি-ভেদে কোনো রূপান্তর ঘটে না তাকে অব্যয় বলে।
ব্যয় বা রূপান্তর হয় না বলেই এরকম নাম।
অব্যয়ের প্রধান কাজ পদের সঙ্গে পদের বা বাক্যের সঙ্গে বাক্যের সংযোগ স্থাপন করা।
অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগ:
বাংলায় অব্যয় প্রধানত ৪ প্রকার। যথা-
১)পদান্বয়ী অব্যয় ২) সমুচ্চয়ী অব্যয় ৩)অনন্বয়ী অব্যয় ও ৪) ধ্বন্যাত্মক অব্যয়
১)পদান্বয়ী অব্যয়:
যে অব্যয়গুলি বাক্যস্থ পদগুলির মধ্যে অন্বয় বা সম্পর্ক স্থাপন করে, তাদের পদান্বয়ী অব্যয় বলে।
এই শ্রেণির অব্যয়কে প্রয়োগ অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) অবস্থানবাচক : স্বাধীনতা সহনশীলতার সঙ্গেই উপভোগ করতে হয়।
নাম বিলায়ে প্রেমের গোরা নিতাই সাথে নেচে যায়।
সঙ্গে, সহিত, সাথে, পশ্চাতে, পিছে, পিছনে, সম্মুখে, সামনে , আগে, ভিতরে, পাশে, নীচে, উপরে, মাঝে, বাইরে, বামে প্রভৃতি এই ধরনের অব্যয়।
খ) উপমাবাচক : ভূতের মতন চেহেরা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর। বেটা যেন দৈত্য। সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। পিতার ন্যায় পূজনীয়। আহা মুখ নয়,যেন চাঁদ!
মতো, মতন, যেন, যেমন, ন্যায়, সম, পারা, প্রায়, তুল্য প্রভৃতি।
গ) সীমাবাচক : পর্যন্ত, অবধি, তক, থেকে, পেরিয়ে, ছাড়িয়ে প্রভৃতি।
ঘ)ব্যতিরেকাত্মক : জ্ঞানের জিনিস দান করলে বাড়ে বই কমে না। এক সীতা বিহনে সকল অন্ধকার।
বিনা,বিনে,বিনি, বিহনে, ব্যতীত, বই, ছাড়া, ভিন্ন, ব্যতিরেকে, বাদে প্রভৃতি।
ঙ)অনুসর্গরূপে প্রযুক্ত : নূতনের জন্য ইচ্ছা খুবই হইতেছে। সকলের তরে সকলে আমরা।
দরুন, নিমিত্ত, তরে, জন্যে, বাবদ, উদ্দেশ্যে, প্রতি, অভিমুখে,
২) সমুচ্চয়ী অব্যয় :
যে সব অব্যয় একাধিক পদ , বাক্যাংশ বা বাক্যেকে সংযোজন বা বিয়োজন করে তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে।
এই শ্রেণির অব্যয়কে প্রয়োগ অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) সংযোজক অব্যয় :
যে অব্যয় দুটি পদ বা দুটি খণ্ডবাক্যকে যুক্ত করে, তাকে সংযোজক অব্যয় বলে।
উদাহরণ : মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা।
দুই আর দুয়ে চার।
সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল।
এবং, ও, আর, তথা হল সংযোজক অব্যয়।
খ) বিয়োজক অব্যয় :
যে অব্যয় দুটি বিকল্পের মধ্যে একটিকে প্রতিষ্ঠা করে এবং অপরটিকে খারিজ করে, তাকে বিয়োজক বা বৈকল্পিক অব্যয় বলে।
উদাহরণ : এই জীবনটা ভালো কিংবা মন্দ কিংবা যা হোক একটা কিছু। তুমি ঘুমাবে না,যাবে।
অথবা,বা, কিংবা, না ইত্যাদি বিয়োজক অব্যয়।
গ) সংকোচক অব্যয় :
যে সব অব্যয় অর্থের সংকোচ সাধন করে, তাকে সংকোচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ : তার এত অর্থ অথচ তিনি সৎকাজে এক পয়সা দেন না। অনেক বোঝানো হল তবু সে তার মত বদলাল না। অঙ্কিতা সব বুঝল,কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারল না।
কিন্তু,অথচ, তবুও, তথাপি ইত্যাদি সংকোচক অব্যয়।
ঘ) হেতুবাচক অব্যয় :
হেতু বা কারণ নির্দেশ করে যে অব্যয় তাকে হেতুবাচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ: তাঁর কথা শেষ পর্যন্ত রাখতে হল, যেহেতু তিনি গুরুজন। বাড়ি আমাকে যেতেই হবে , কেননা এ আমার মায়ের আদেশ।
কেননা, যেহেতু,কারণ, ইত্যাদি ।
ঙ) সিদ্ধান্তবাচক বাচক:
যে সব অব্যয় সিদ্ধান্ত বা মীমাংসাসূচক অর্থ প্রকাশ করে দুটি বাক্যকে যুক্ত করে তাকে সিদ্ধান্তবাচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ: তুমি অলস এইজন্য তোমার উন্নতি হবে না।এ আমার মায়ের আদেশ, কাজেই আমাকে মানতেই হবে।
চ) সংশয়-সূচক:
যে সব অব্যয়ের দ্বারা সংশয়ের ভাব প্রকাশিত হয়, তাকে সংশয়-সূচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ : ওই বুঝি বাঁশি বাজে! লোকটা বুঝি পাগল!
যদি, পাছে, বুঝি ইত্যাদি সংশয়-সূচক অব্যয়।
ছ) সাপেক্ষ বা নিত্যসম্বন্ধী :
যে সব অব্যয় জোড়ায় জোড়ায় ব্যবহৃত হয়, একটি ভিন্ন অপরটি ব্যবহৃত হয় না এবং যাদের মধ্যে নিত্য-সম্বন্ধ থাকে তাদের
নিত্যসম্বন্ধী বা সাপেক্ষ অব্যয় বলে।
উদাহরণ : তুমি যদি বুনো ওল আমি তবে বাঘা তেঁতুল। আপনি যদি বলেন, তবে সেখানে যাব। হয় জয়,নয় মৃত্যু। যেমন প্রভু,তেমনি তার ভৃত্য। তাজমহল এত সুন্দর যে ,পৃথিবীর নানা দেশ থেকে লোক দেখতে আসে।
যদি…তবে, যত…তত, বরং…তবু, এত…যে, যেই…সেই , যখন…তখন ইত্যাদি এই শ্রেণির অব্যয়।
জ) ব্যতিরেকাত্মক :
যে সব অব্যয় অভাব বা ভেদ অর্থটি প্রকাশ করে তাকে ব্যতিরেকাত্মক অব্যয় বলে।
উদাহরণ: অদৃষ্ট যদি না মন্দ হবে, এমন হবে কেন? তাড়াতাড়ি চল,নইলে গাড়ি ধরতে পারবো না। সত্য বলো নতুবা শাস্তি পাবে।
যদি না, নতুবা,নচেৎ, নইলে প্রভৃতি এই ধরণের অব্যয়।
৩) অনন্বয়ী অব্যয়
যে অব্যয়গুলি বাক্যের মধ্যে কোনো প্রকার সম্বন্ধ স্থাপনে ভূমিকা গ্রহণ করে না, তাদের অনন্বয়ী অব্যয় বলে।
অনন্বয়ী অব্যয়ের প্রধান ভাগগুলি হল-
ক) আবেগসূচক অব্যয় :
যে অব্যয়গুলির দ্বারা বক্তার মনের আবেগ বা বিভিন্ন ভাব বোঝানো হয়, তাদের আবেগসূচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ :
বিস্ময়সূচক : ওমা ! এ যে দাদা। বাঃ ,কী সুন্দর আকাশ!
বাঃ, ওমা,আহা, অ্যাঁ, সে কি প্রভৃতি।
ঘৃণা বা বিরক্তিসূচক : ছি ছি! একথা কি মুখে আনতে আছে,বাবা? ধিক্ ধিক্, ওরে শত ধিক্ তোকে। তবে ছোটো লোকের দুঃখে কাতর,ছি! কে হইবে?
ছি ছি, ধিক্ ধিক্ , দুত্তোর দূর ছাই, কী জ্বালা প্রভৃতি।
ভয়,দুঃখ,যন্ত্রনাসূচক : এ জগতে হায়,সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। ওরে বাবা! এ যে সত্যি বাঘ। হায় হায়! সর্বনাশ হয়ে গেল।
উঃ,ইস্, ওঃ, বাপরে বাপ, ওরে বাবা, হায় ইত্যাদি এই ধরণের অব্যয়।
আনন্দসূচক : হুররে,
প্রশংসাসূচক: আ মরি বাংলা ভাষা!
শাবাশ,বাহবা,বেশ,আ মরি প্রভৃতি।
খ) সম্মতিজ্ঞাপক অব্যয় :
যে সব অব্যয় বক্তার সম্মতি প্রকাশ করে, তাকে সম্মতিজ্ঞাপক অব্যয় বলে।
উদাহরণ : হ্যাঁ, আমি পরীক্ষা দেব।
হ্যাঁ, হুঁ, ঠিক আছে, আচ্ছা ইত্যাদি।
গ) অসম্মতিজ্ঞাপক অব্যয়
যে সব অব্যয় বক্তার অসম্মতি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তাকে অসম্মতিজ্ঞাপক অব্যয়
বলে।
উদাহরণ : না,ওটা পারব না। কই,না তো।
না, কক্ষণো না, আদৌ না,মোটেইনা ইত্যাদি।
ঘ) প্রশ্নবাচক অব্যয়
যে সব অব্যয় প্রশ্ন করার কাজে ব্যবহৃত হয়, তাকে প্রশ্নবাচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ: তোরা নাকি নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাচ্ছিস ? মারবে না কি ? কাল থেকে তোমাদের পরীক্ষা, না ?
ঙ) আলংকারিক অব্যয়
যে অব্যয়গুলি স্পষ্ট কোনো অর্থ বহন করে না কিন্তু বাক্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে ,তাদের আলংকারিক অব্যয় বা বাক্যালংকার অব্যয় বলে।
উদাহরণ: এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়। কত না দিনের দেখা, কত না রূপের মাঝে।
চ) সম্বোধন-সূচক অব্যয়
যে সব অব্যয়ের দ্বারা কাউকে সম্বোধন করা বোঝায় তাকে সম্বোধন-সূচক অব্যয় বলে।
উদাহরণ: হে বন্ধু; ওহে কর্ণধার। ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
৪) ধ্বন্যাত্মক অব্যয়
যে সব অব্যয় বাস্তব ধ্বনির ব্যঞ্জনা দেয় বা অনুভূতিগ্রাহ্য কোনো ভাব বোঝায় তাকে ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে।
উদাহরণ: হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন। গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে। ঝকঝক কলসির বকবক শোন গো। প্রথমে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর। মায়ের জন্য মনটা টনটন করছে।
কলকল, ধুপধাপ, ছলছল, ছটফট, টনটন, দাউদাউ, কনকন, ঝমঝম, টপাটপ, ঝুমঝুম, দরদর, বকবক, ফিসফিস, সনসন, টুংটাং ইত্যাদি ধ্বন্যাত্মক অব্যয়।
Comments are closed.