বিধায়ক ভট্টাচার্য
জন্ম : ১৯০৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি।
মৃত্যু : ১৯৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর।
আমাদের মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের ভূমিপুত্র তিনি। তিনি ছিলেন নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ।
মুর্শিদাবাদের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বিধায়ক নামটি একদা কলকাতাতেও সুপরিচিত ছিল। তিনি তাঁর অভিনয়ের গুণে, লেখনির দাপটে ওই সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম বগলাচরণ ভট্টাচার্য। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া বিধায়ক নামেই তিনি বেশি পরিচিত। বাবা হরিচরণ ভট্টাচার্য জিয়াগঞ্জ বালুচরের ভট্টাচার্য বামুন ছিলেন। যজমানি তাঁর পেশা ছিল। জিয়াগঞ্জ শ্মশানযাত্রার পথে যেতে হয় বিধায়ক ভট্টাচার্যের ভগ্নপ্রায় আদি নিবাসের পাশ দিয়ে। ভট্টপাড়ার শেষ মাথায় ছিল শীতল ডোমের বাড়ি।
টানা পথ ধরলে সেই ডাকাতে দেওয়ান দেবী সিংহের আস্তানা। নশিপুর রাজবাড়ি। মাঝখানে গা ছমছমে হরিগঞ্জের বাগান। খুন, লাশ-গুম, ভূতে পাওয়া সে বাগান। বগলাচরণের আশৈশব চইচই করা ছিল সেই পরিবেশ। বাল্যস্মৃতি বিজড়িত রাজা বিজয় সিংহ বিদ্যামন্দির বিধায়কের বাড়ির উত্তর কোণে। ক্লাস ঘরের চৌহদ্দিতে মহেন পণ্ডিতের লাঠ্যৌসধি। না! এখানে তাঁর মন টেকেনি তাঁর। তাঁর শিল্পী মন বলে, ‘চল পালাই! অন্য কোনও খানে।’ এ ভাবেই কৈশোরে কলকাতায় তাঁর পাড়ি দেওয়া। আশ্রয় মিলল এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক বিধায়ক ভট্টাচার্য কলকাতায় খুঁজে নিলেন জীবন প্রতিষ্ঠার আশ্রয় এবং প্রশয়। কলকাতার টালা স্কুলে ভর্তি হলেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বিয়ে করেন কলকাতাতেই। সেই সূত্রে ১৯২৯ সালে কলকাতায় শেকড় গাঁথেন তিনি। কিছু কাল পেশাগত সূত্রে যুক্ত হলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির নাট্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে। ফলে নাটক এবং নাট্যভিনয়ের গভীরে অবগাহনের সুযোগ পেলেন তিনি। ১৯৩২ সালে সেই নাট্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হল নাটক ‘দেহ যমুনা’। তার পরে ১৯৩৭-১৯৩৮ সালে পেশাদারি ভাবে সেই নাটকটিই রঙমহলে অভিনীত হল। অন্য দিকে ‘যুগান্তর’ ও ‘অমৃতবাজার পত্রিকায়’ সাংবাদিকতা শুরু করলেন তিনি। ‘রঙমহল’ থেকে ‘কালিকা’ ‘মিনার্ভা’, ‘বিশ্বরূপা’, ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’ তাঁকে করে তুলল অপ্রতিরোধ্য এক অসাধারণ নট ও নাট্যকার। ‘বিশ্বরূপা’য় তাঁর ‘ক্ষুধা’ নাটক অভিনীত হয়েছে টানা আড়াই বছরের উপরে।
নাট্যভিনয়ে দর্শকের হৃদয় জয় করেন তিনি। শুধুমাত্র নাটকই নয়, তাঁকে টেনেছিল কবিতা, গল্প, উপন্যাসও। স্বনামে ও ছদ্মনামে লেখনি স্রোত অব্যাহত ছিল। ছদ্মনাম কখনও ‘মানস দাস’, কখনও বা ‘যশোধর মিশ্র’। তাঁর অভিনীত বিখ্যাত নাটক ‘মাটির ঘর’, ‘রক্তের ডাক’, ‘তেরোশো পঞ্চাশ’, ‘রাজপথ’, ‘অতএব’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’, ‘অন্ধ দেবতা’, ‘সেতু’ আরও কত কী! ‘সেতু’ নামের নাটকটি কলকাতায় দীর্ঘ দিন চলেছিল। সেই সময়ে ওই নাটক বিপুল হইচই ফেলে দিয়েছিল! ‘বৃদ্ধ বিধাতা’, বা ‘রাত্রি যাদের দিন’, ‘অসমাপ্ত’— আর কিছু নাটক তাঁর নিজের লেখা উপন্যাসের নাট্যরূপ। সেই নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। তাঁর লেখা বিখ্যাত ‘ঢুলি’ প্রথমে নাটমঞ্চে ও পরে সিনেমার আকারে পর্দায় তুফান তুলেছিল। সে কথা স্মরণ করলেই মনে পড়ে জিয়াগঞ্জের বাংলামন্দিরের দুর্গার তৃতীয় নয়ন আঁকার সময় তিনি কেমন মগ্ননয়নে তাকিয়ে থাকতেন। বিধায়ককে বিধায়ক হিসাবে গড়ে তুলতে বাংলামন্দিরের কুঞ্জ ঢুলির অবদান অসামান্য। সেই নাটক ও সিনেমায় মূল বিষয় ঢুলির সঙ্গে অভিজাত এক মহিলার প্রেম। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেরও তিনি জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন। ‘ভ্রান্তি বিলাস’- এর সেই স্যাকরার মুখে মুর্শিদাবাদের, বিশেষত বালুচরের ডায়ালেক্ট তিনি গুঁজে দিয়েছেন সফল ভাবে। ‘উত্তর মেঘ’ ছবিতেও তাঁর ভূমিকা অনবদ্য।
আকাশবাণীতে বার বার অভিনীত হয়েছে তাঁর নাটক ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’ (নাটকটি শুনতে এখানে ক্লিক করুন)। শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্র অভিনীত ওই নাটক আজও বঙ্গ সংস্কৃতি জগতের সাড়া জাগানো সম্পদ। বিধায়কের লেখা ‘সরীসৃপ’ অখিল ভারতীয় কার্যক্রমের নাটক প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে দেখতে গিয়েছিলেন বিধায়কের লেখা নাটক ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’। ‘ভ্রান্তি বিলাস’ অন্য মাত্রা পেয়েছিল বিধায়ক অভিনীত স্যাকরার ভূমিকার কারণে। উত্তম-ভানুর দ্বৈত চরিত্র যেমন দর্শকের মন কেড়েছিল, তেমনই ছিল বিধায়কের স্যাকরার ভূমিকার অভিনয়। সেখানে তাঁর জন্মভূমির টান ডায়লগে ফুটিয়ে তুলতে তিনি ভোলেননি। চলচ্চিত্রের সংলাপ হররোজ লিখতেন। উত্তম-সাবিত্রীর ‘রাজা সাজা’, ভানু-সাবিত্রীর ‘পথে হল দেখা,’ উত্তম-তনুজা জুটি অভিনীত ‘দেওয়া নেওয়া’ রমরমিয়ে চলেছিল। ওই সিনেমাগুলোর সংলাপ লেখেন বিধায়ক। মৃণাল সেন পরিচালিত ‘অবশেষে’র উকিল, ‘গাঁয়ের মেয়ে’তে কবি, ‘উত্তর মেঘ’–এ উকিল, ‘সুধা’ ছবিতে গগন পাড়াই, ‘অবাক পৃথিবী’র দোকানদার— এমন কত না বর্ণময় চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন!
অদ্ভুত ভাবে তিনি বুঝতেন সব শ্রেণির দর্শকের চাহিদা, তাঁদের মন। বিধায়কের লেখা ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’ নাটক শম্ভু–তৃপ্তি জুড়ির অভিনয়গুণে দর্শক মোহিত হয়ে পড়ে। বিধায়ক তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, নাটক দেখে দর্শকেরা নিজেদের অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, রঞ্জনার চুল টেনে পল্লিগ্রামের মেয়েদের মতো করে বাঁধা থাকবে। পরনে থাকবে লম্বাদাগের (কালো হলে ভাল হয়) শাড়ি। পণ্ডিতের পরনে ফতুয়া, সাদা চাদর, ধুতি, আর বিদ্যাসাগরি চটি। কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক থাকবে না। জোনাকি, ঝিঝি, শেয়ালের ডাক, ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ মিউজিকের কাজ করবে।
মধ্যবিত্ত সমাজের ক্রমাগত অবনমন ও অর্থনৈতিক দুর্দশা বিধায়কের নাট্যচিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে আছে। নাটক এবং নাট্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁর গভীর অভিনিবেশ, নাটকের উপস্থাপনের নানা কৌশল, প্রেক্ষা ও নিরীক্ষা তাঁকে শিখিয়েছিল পেশাদারি নাটকের ক্ষেত্রে কী করে দর্শককে মুগ্ধ করতে হয়। বাল্য-কৈশোরে জিয়াগঞ্জের সামাজিক পরিবেশ, গঙ্গা, বাংলা মন্দিরের মা দুর্গার চোখ আঁকা, রায়বাহাদুরের বাড়ির ঝুলনযাত্রা, কমলেকামিনীতলার মেলা, চুড়িপট্টির দাসভবনে তাসের আড্ডা আর মাঝরাতে শব-বাহকের হরিধ্বনির মধ্যেই গড়ে উঠেছিল ভবিষ্যতের বিধায়কের শিল্প-শৈলীর ভিত। জন্মভূমির সেই ফেলে আসা অতীত বিধায়ককে টেনেছে বারবার। শেকড়ের টান তিনি ভোলেননি।
তাঁর ৭৯ বছরের জীবননাট্যে কত না বৈচিত্র্য! এক বার জঙ্গিপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সারা বাংলা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা। বিধায়ক ভট্টাচার্য বিচারক ছিলেন।
তাহার নামটি রঞ্জনা নাটকের আলোচনা
শ্রুতি নাটক : তাহার নামটি রঞ্জনা
প্রেমের ছন্দ পড়ে খুব ভালো লাগলো ধন্যবাদ
‘তাহার নামটি রঞ্জনা’ এই নাটকের PDF টি পাওয়া যাবে?