থর্নডাইকের শিখনের তত্ত্ব :
থর্নডাইকের সংযোজনবাদ (Connectionism)
শিখনের প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্ব
(Trial and Error Theory of Learning ):
আমেরিকান মনােবিদ এডওয়ার্ড লি থর্নডাইক (Edward Lee Thorndike) উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযােগস্থাপনের মাধ্যমে প্রচেষ্টা ও ভুলের কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি বিভিন্ন প্রাণির শিখন সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং ‘Animal Intelligence’ জার্নালে শিখন সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তাঁর মতে “Learning is due to the connection stimulus and response.” অর্থাৎ উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যথাযথ সংযোগ স্থাপনই হল শিখন। এই কারণেই এই তত্ত্বকে সংযোজনবাদ বলে।
থনডাইকের মতে শিখন সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, প্রতিরূপ প্রভৃতি কতগুলি মানসিক এককের সংযোগে সৃষ্ট। একে অনুষঙ্গবাদ বলে।
থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্বের পরীক্ষা:
থর্নডাইকের মতে প্রাণিরা বারবার প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শেখে। থনডাইক কুকুর বিড়াল মানুষ প্রভৃতির উপর পরীক্ষা করেছিলেন তবে ক্ষুধার্ত বিড়ালের উপর তাঁর পরীক্ষাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রথম অবস্থায় প্রাণি কোনো কিছু বিষয় শিখতে গেলে ভুল করে এবং ধীরে ধীরে সেই ভুলের মাত্রা কমে ও তার প্রকৃত আচরণের পরিবর্তন এর মাধ্যমে শিখন লাভ ঘটে।
প্রচেষ্টা ও ভুল পরীক্ষাটি করার জন্য তিনি একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালকে খাঁচার মধ্যে রেখে দেন এবং বাইরে রাখেন খাবার (মাছ)। খাঁচাটিতে একটি দরজা থাকে, যেটি খোলার জন্য খাঁচার নির্দিষ্ট স্থানে একটি লিভার যন্ত্রের চাপ দিতে হয়।
খাঁচার মধ্যে থাকা ক্ষুধার্ত বিড়ালটি খাবার দেখামাত্র উদ্দেশ্যহীন ও বিশৃঙ্খলভাবে ছোটাছুটি করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষন বৃথা চেষ্টা করার পর হঠাৎ নির্দিষ্ট স্থানে থাকা লিভার যন্ত্রে পা পড়ে দরজা খুলে যায়।
দ্বিতীয়বার তিনি এই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেন। বিড়ালটি পূর্বের মতোই উদ্দেশ্যহীন এবং পরিকল্পনাহীন ভাবে আচরণ করে। হঠাৎ তার পায়ের চাপে দরজা খুলে যায় এবং বাইরে এসে বিড়ালটি খাবার খায়।
থর্নডাইক লক্ষ্য করেন বিড়ালটির ওপর, প্রথমবারে সমস্যা সমাধানের কোনো প্রভাব দ্বিতীয় বার পড়েনি। কেবলমাত্র প্রথমবার থেকে কম চেষ্টা ও কম সময়ে বিড়ালটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার সমস্যা সমাধান করেছে।
তৃতীয়বারের পরীক্ষাটিতে চেষ্টার সংখ্যা এবং সময় আরো কম লেগেছে। এভাবে পরীক্ষাটি কয়েকবার করে থর্নডাইক দেখলেন বিড়ালটির ব্যর্থ প্রচেষ্টা ক্রমশ কমছে।
অবশেষে একসময় দেখা গেল বিড়ালটিকে খাঁচার মধ্যে ঢোকানোর পরেই অনায়াসে নির্দিষ্ট স্থানে চাপ দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে খাবার খায় কোনো ভুল প্রচেষ্টা ছাড়াই। অর্থাৎ বিড়ালটির শিখন সম্পূর্ণ হয়।
থনডাইকের পরীক্ষার ফলাফলগুলিকে বিচার করলে শিখন প্রক্রিয়ার কয়েকটি স্তর পাওয়া যায়। স্তরগুলি হল –
১. তাড়না
২. লক্ষ্য
৩. বাধা
৪. উদ্দেশ্যহীন প্রচেষ্টা
৫. হঠাৎ সাফল্য
৬. সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন
৭. সঠিক পদ্ধতি স্থিরীকরণ
বিড়ালটি প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে উদ্দীপকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াটির সংযোগ ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন কে একটি লেখচিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায়।
সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রাণি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া করবে এবং কীভাবে শিখন লাভ করবে সেই সংক্রান্ত তিনটি মুখ্য সূত্র এবং পাঁচটি গৌণ সূত্রের কথা বলেছেন তিনি।
থর্নডাইকের মুখ্য সূত্র
(১) প্রস্তুতির সূত্র(Law of readiness)
(২) ফললাভের সূত্র(Law of effect )
(৩)অনুশীলনের সূত্র(Law of exercise )
(১) প্রস্তুতির সূত্র: থর্নডাইক শিখনের মুখ্য সূত্রে দৈহিক প্রস্তুতির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, উদ্দীপক ও তার উপযােগী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযােগ স্থাপনের জন্য ব্যক্তির দৈহিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়ােজন। সংযােগ স্থাপনের জন্য যদি ব্যক্তি প্রস্তুত থাকে তাহলে সংযােগ স্থাপন করতে দিলে সে তৃপ্তিবােধ করবে। ব্যক্তির যদি প্রস্তুতি থাকে, সেক্ষেত্রে জোর করে সংযােগ স্থাপন করতে দিলে সে বিরক্তিবােধ করবে।
(২) ফললাভের সূত্র: উদ্দীপক (S) ও প্রতিক্রিয়া (R)-এর সংশােধনযােগ্য সংযােগের ফল যদি শিক্ষার্থীর কাছে সুখকর বা আনন্দদায়ক হয় তবে সংযােগটি শক্তিশালী হয় অর্থাৎ S-R বন্ধন দৃঢ় হয়। অপরপক্ষে সংযােগের ফল যদি অতৃপ্তকর বা বিরক্তিকর হয়, তবে সংযােগটি (S-R বন্ধন) দুর্বল হয়।
(৩)অনুশীলনের সূত্র:
এই সূত্রটি দু-ভাগে বিভক্ত—
ব্যবহারের সূত্র: সমস্ত শর্ত অপরিবর্তিত রেখে উদ্দীপকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পরিবর্তনীয় বন্ধন স্থাপনের পর বারবার চর্চা করা হলে সেই সংযােগের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
অব্যবহারের সূত্র: কোনাে পরিবর্তনীয় উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া বন্ধন স্থাপনের পর বহুদিন চর্চা না করলে তাদের বন্ধন ক্রমে শিথিল হতে থাকে।
থর্নডাইকের গৌণ সূত্র
(১) মানসিক প্রস্তুতির সূত্র: যে-কোনাে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির মানসিক প্রস্তুতি বিশেষ প্রয়ােজন। অর্থাৎ প্রেষণা, আগ্রহ, মনােযােগ, বুদ্ধি, স্মৃতি ইত্যাদির দিক থেকে প্রস্তুতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
(২) বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার সূত্র: প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখনে প্রাণী সঠিক প্রতিক্রিয়াটি করার আগে একই উদ্দীপকে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া করে সমস্যাটির সমাধান করতে চায়। এটি হল বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার সূত্র।
(3) আংশিক প্রতিক্রিয়ার সূত্র: থর্নডাইকের মতে, প্রাণী সামগ্রিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে প্রতিক্রিয়া করে না। প্রতিক্রিয়া করার সময় প্রাণী। অংশভিত্তিক প্রতিক্রিয়া করে সম্পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়।
(৪) উপমানের সূত্র: থর্নডাইকের এই সূত্রানুযায়ী, প্রাণী যখন কোনাে নতুন সমস্যামূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন পূর্বের কোনাে অবস্থার সঙ্গে আংশিক মিল খুঁজে বার করে। পূর্বে যেভাবে প্রতিক্রিয়া করে সমস্যার সমাধান করেছিল বর্তমানে সেভাবে প্রতিক্রিয়া করে সমাধানসূত্র বের করার চেষ্টা করে।
(৫) অনুষঙ্গমূলক সঞালন সূত্র: থর্নডাইক তার অনুষঙ্গামূলক সঞ্চালন সূত্রে বলেছেন, প্রাণী যখন কোনাে উদ্দীপকের উপযােগী প্রতিক্রিয়াটি করতে সক্ষম হয়, তখন সেই প্রতিক্রিয়াটি যে-কোনাে উদ্দীপকের সঙ্গে যুক্ত করা যায়।
প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনের বৈশিষ্ট্য :
থর্নডাইকের ‘প্রচেষ্টা ও ভুল’-তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করলে আমরা কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাই। এই শিখন কৌশলের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(১) আত্মসক্রিয়তা
(২) পুনরাবৃত্তি
(৩) উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন
(৪) বহুমুখী প্রতিক্রিয়া
(৫) আংশিক প্রতিক্রিয়া
(৬) জৈব-মানসিক প্রস্তুতি
(৭) ফললাভ
(৮) সাদৃশ্যভিত্তিক প্রতিক্রিয়া
(৯) প্রচেষ্টার সংখ্যা ও সময় ক্রমহ্রাস
(১০) সর্বজনী
(১১) জানা থেকে অজানা বিষয়ের দিকে যাওয়া