ভাষাবৈচিত্র্য ও বাংলা ভাষা
ভাষা বহমান নদীর মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায়। ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে ইন্দো-ইরানীয় হয়ে কীভাবে তিনহাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আজকের বাংলা এল, সেই বিবর্তনের ধাপগুলো নিয়ে যে চর্চা করা হয় তাকে বলা যেতে পারে ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব। ভাষার ধ্বনি ও রূপ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়বৃত্তে এই যে আলোচনা বা চর্চা, একে বলা যেতে পারে এককালীন ভাষাতত্ত্ব।
বাংলা ভাষার মধ্যে নানা রকমফের রয়েছে। আর এটা যে শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়। পৃথিবীর সব ভাষার মধ্যেই এটা দেখা যায়। তবে যে ভাষার ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও ভাষাভাষীর সংখ্যা বেশি, সেই ভাষার ক্ষেত্রে এই রকমফেরের ধরন ও সংখ্যাও বেশি।
উপভাষা :
একই ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক পৃথক রূপকে উপভাষা বলে।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে কলকাতা, হুগলি, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনার মানুষের মুখের ভাষা আর পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মানুষের মুখের ভাষা কিংবা জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের মানুষের মুখের ভাষা আলাদা। সুকুমার সেন প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলার এই আঞ্চলিক বৈচিত্র্যগুলিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন – রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, বঙ্গালী, কামরূপী ও ঝাড়খণ্ডী। ভাষার এই আঞ্চলিক রূপকে ‘উপভাষা’ (Dialect) বলা হয়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই পাঁচটি প্রধান উপভাষা।
পাঁচটি উপভাষা ও তাদের অবস্থান :
রাঢ়ী :
রাঢ়ী বলতে ভাগীরথী-হুগলি নদীর আশেপাশে ব্যবহৃত বাংলা। মধ্য-পশ্চিমবঙ্গ (পশ্চিম রাঢ়ী বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব বাঁকুড়া। পূর্ব রাঢ়ী-কলকাতা, ২৪-পরগনা, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, উত্তর-পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ)।
বঙ্গালী :
পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ (ঢাকা, মৈমনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোহর, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম)।
বরেন্দ্রী :
উত্তরবঙ্গ (মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা)
ঝাড়খণ্ডী :
পশ্চিমবাংলার পশ্চিমপ্রান্তের ঝাড়খণ্ডের মানভূম-সিংভূম ও ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন পুরুলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর ইত্যাদি।
কামরূপী :
জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আসামের কাছাড় ইত্যাদি
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে এতগুলি যদি বাংলার ঔপভাষিক অঞ্চল হয়, তাহলে কোন অঞ্চলের ভাষা ‘বাংলা’? আসলে যে-কোন ভাষা হল তার নানা উপভাষার একটা বিমূর্ত রূপ। এই সব উপভাষা মিলিয়েই বাংলা ভাষা। এই উপভাষাগুলোর মধ্যে কোনো একটি উপভাষাকে ‘Standard’ বা মান্য ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। যেমন বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া হয়েছে যে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষাই হল মান্য ভাষা।
উপভাষা শৃঙ্খল বা Dialect Continuum :
কোনো ভাষার অন্তর্গত উপভাষাগুলির মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতা বা সাদৃশ্য না-থাকলেও উক্ত ভাষার মান্য চলিত রূপটি সমস্ত উপভাষাভাষী মানুষদের মধ্যেই বোধগম্য। অর্থাৎ এভাবেই মান্য চলিতের সঙ্গে সমস্ত উপভাষাগুলি শৃঙ্খলিত। একেই বলা হয় উপভাষা শৃঙ্খল বা ‘Dialect Continuum’।
সমাজভাষা বা Sociolect :
সামাজিক স্তরভেদে ভাষার বৈচিত্র্যকে বলে সমাজভাষা বা Sociolect।
ব্যক্তিভাষা বা বিভাষা বা ideolect :
বিভাষা বা ব্যক্তিভাষা হল, একই আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহারকারী একই শ্রেণির মানুষের মধ্যে যখন ব্যক্তি অনুসারে ভাষা প্রয়োগে স্বাতন্ত্র্য দেখা যায়। ব্যক্তিমানুষের ভাষা ব্যবহারের বৈশিষ্ট্যই বিভাষার ভিত্তি।
সাধু ও চলিতরীতি:
অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভাষা মুখের ভাষা থেকে কিছুটা পৃথক্ হয়ে থাকে।
এরকমের পৃথকতা সব দেশের সব উন্নত ভাষার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। বাংলা ভাষাতেও এই দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে।
যে সাহিত্যের ভাষা উন্নত চিন্তা, কল্পনা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করে তা অপেক্ষাকৃত মার্জিত, পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত।
যে মুখের ভাষা আমরা দৈনন্দিন জীবনে পথে-ঘাটে-হাটে-বাজারে সাংসারিক কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করি তা অপেক্ষাকৃত অপরিমার্জিত, অপরিকল্পিত, অবিন্যস্ত, এলোমেলো।
কিন্তু লেখার ভাষায় কি কোনো বৈচিত্র্য আছে? বাংলা ভাষার লিখিত রূপের দিকে তাকালে সেখানেও আমরা প্রধানত দুটি রূপ দেখতে পাব। একটি সাধু, অন্যটি চলিতরীতি।
সাধু :
যে গদ্যে অধিক সংখ্যক বিশুদ্ধ তৎসম শব্দ, ক্রিয়া-সর্বনামের দীর্ঘরূপ, সমাসবদ্ধ পদ এবং বাক্যের পদবিন্যাসের ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতাসম্পন্ন বিদগ্ধ, গম্ভীর ও সাহিত্যে সীমাবদ্ধ যে ভাষা, তাকেই সাধুভাষা বলা হয়।
চলিত :
চলিত ভাষা হল জীবন্ত ভাষা। বাংলার মানুষের মুখের জীবন্ত ভাষার যে পাঁচটি প্রধান উপভাষা (রাঢ়ী, বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, কামরূপী ও ঝাড়খণ্ডী), সেগুলির মধ্যে রাঢ়ীর কলকাতা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের (হুগলি, হাওড়া, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা) রূপের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই সর্ববঙ্গীয় আদর্শ চলিত বাংলা (Standard Colloquial Bengali)। এই কথ্যভাষার প্রধানত মান্য কথ্যভাষার কাছাকাছি, তদ্ভব শব্দ, ক্রিয়া-সর্বনাম-অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ, দেশি ও বিদেশি শব্দের ব্যবহারে এবং বাক্যে পদবিন্যাসের কিছুটা শিথিল নিয়মসম্বলিত যে বাংলা ভাষা তাকে আমরা চলিতরীতি বলি।
উনিশ শতকে লিখিত বাংলা ভাষা হিসেবে যখন সাধুরীতির প্রচলন ছিল ব্যাপক, তখন চলিতরীতির ধারাটি ছিল ক্ষীণ। সাধুরীতির রূপটি গড়ে ওঠে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের হাতে; তারপরই রামমোহন রায়ের ‘বেদান্তগ্রন্থ‘-এ আরও যুক্তিনির্ভর দৃঢ়পিনদ্ধ রূপটি পাওয়া যায় এবং তিনি এই ‘সাধুভাষা‘ কথাটি ব্যবহার করেন।
উনিশ শতক জুড়ে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সাধুরীতির এই গৌরবময়তায় পাশে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল‘ আর কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা‘র চলিতরীতির উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। পরে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী ও তাঁর ‘সবুজপত্র‘কে ঘিরে চলিতরীতি ক্রমশই স্থান করে নেয় সাহিত্যের অঙ্গনে। তারপর ক্রমেই সাধুরীতির ধারাটি হয়ে এল ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর, চলিতরীতি হলো লিখিত বাংলা ভাষার প্রধান বাহন।
সাধু আর চলিতরীতির প্রধান পার্থক্য সর্বনাম এবং ক্রিয়ার রূপে। এছাড়া আরও কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। নীচে পার্থক্যগুলি সূত্রাকারে দেখানো হল।
ক) চলিতরীতির মূল ভিত্তি মৌখিক ভাষা। এই কারণে চলিতরীতির লিখিত রূপেও অনেক সময় মৌখিক উচ্চারণের সরাসরি প্রভাব দেখা যায়।
সাধু চলিত
কোন, কোনও কোনো
কর করো
খ) বাংলা ভাষার মৌখিক উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ তারতম্য নেই বলে তদ্ভব শব্দে হ্রস্বস্বর ব্যবহারের রীতি চলিতরীতিতে বহুল প্রচলিত।
সাধু চলিত
পাখী পাখি
রূপা রুপো
গ) মৌখিক ভাষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য দ্বাক্ষরতা বা দ্বিমাত্রিকতা চলিতরীতিতে গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
সাধু চলিত
জানালা জান্ লা
রবিবার রোব্ বার
ঘ) দ্বিবচনবাচক শব্দগুলি সাধু ও চলিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
সাধু চলিত
ভ্রাতৃদ্বয় দুই ভাই, ভাই দুটি
পাখী দুটি পাখি দুটো
ঙ) একবচনের ক্ষেত্রে সাধুতে-‘টি’ বা ‘খানি’ নির্দেশকগুলি যুক্ত হয়, চলিতে নির্দিষ্ট কর্তার সঙ্গে যুক্ত হয় -’টা’ বা -খানা’। বহুবচনে সাধুরীতিতে’-গুলি’ নির্দেশক যুক্ত হয়, চলিতে তা হয়ে যায়’-গুলো।’
সাধু চলিত
ছেলেটি ছেলেটা
বইখানি বইখানা
গাছগুলি গাছগুলো
চ) সাধুরীতির সর্বনামগুলি চলিতে সংক্ষিপ্তরূপে ব্যবহৃত হয়।
সাধু চলিত
তাহার/তাঁহার তার/তাঁর
তাহাদের তাদের
তাহাদিগকে তাদেরকে/তাদের
কাহারা কারা
ছ) সাধুরীতির ক্রিয়ারীতি থেকে চলিতভাষার ক্রিয়ারীতির সংক্ষিপ্ততর।
সাধু চলিত
ঘটমান বর্তমান-
করিতেছে করছে
পুরাঘটিত বর্তমান
করিয়াছি করেছি
সাধারণ অতীত
করিলাম করলাম
ঘটমান অতীত
করিতেছিলাম করছিলাম
পুরাঘটিত অতীত
করিয়াছিলাম করেছিলাম
জ) চলিতরীতিতে সমাস ব্যবহারের প্রবণতা তুলনায় কম।
ঝ) সাধুরীতিতে সচরাচর বাংলা ভাষার কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া পদবিন্যাসের ক্রমটি রক্ষিত হয়। চলিতরীতিতে সবসময় তা মোটেই মেনে চলা হয় না।
তাহলে বাংলা ভাষার সামগ্রিক বৈচিত্র্য যা উঠে এল আমাদের আলোচনায় তা অনেকটা নীচের ছকের মতো: