পৃথিবীর সকল সাহিত্যের পরিপুষ্টিসাধনে অনুবাদমূলক সাহিত্যকর্মের বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। ভাষার মান বাড়ানোর জন্য ভাষার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়,আর তাতে সহায়তা করে অনুবাদকর্ম। ভাষা ও সাহিত্যের যথার্থ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্পদশালী ভাষায় উৎকর্ষপূর্ণ সাহিত্যসৃষ্টির অনুবাদ একটি আবশ্যিক উপাদান। কিন্তু সাহিত্যের অনুবাদ শিল্পসম্মত হওয়া আবশ্যিক বলেই তা আক্ষরিক হলে চলে না।ভিন্ন ভাষার শব্দ সম্পদের পরিমাণ, প্রকাশক্ষমতা ও বাগভঙ্গি অনুযায়ী ভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত কথায় সংকোচন, প্রসারণ, বর্জন ও সংযোজন আবশ্যিক হয়।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে অনুবাদের ধারাটি সমৃদ্ধি লাভ করে তাতে সৃজনশীল লেখকের প্রতিভা কাজ করেছিল।সে কারণে মধ্যযুগের এই অনুবাদকর্ম সাহিত্য হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। বুলিকে লেখ্য ভাষার তথা সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত করার সহজ উপায় হচ্ছে অনুবাদ।অন্যভাষা থেকে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞান-মননের বিভিন্ন বিষয় অনুবাদ করতে হলে সে বিষয়ক ভাব-চিন্তা-বস্তুর প্রতিশব্দ তৈরি করা অনেক সময় সহজ হয়,তৈরি সম্ভব না হলে মূল ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করতে হয়।এভাবেই সভ্য জাতির ভাষা-সাহিত্য মাত্রই গ্রহণে-সৃজনে ঋদ্ধ হয়েছে।এ ঋণে লজ্জা নেই। যে জ্ঞান বা অনুভব আমাদের দেশে পাঁচশ বছরেও লভ্য হত না,তা আমরা অনুবাদের মাধ্যমে এখনই পেতে পারি।যেমন- বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো,শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তাগুলো,বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো,সমাজতত্ত্বগুলো-মানবচিন্তার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো এভাবে আয়ত্তে আসে।
চৌদ্দ পনেরো শতকে আমাদের লেখ্য সাহিত্যও তেমনি সংস্কৃত-অবহটঠ থেকে ভাব-ভাষা-ছন্দ গ্রহণ করেছে,পুরাণাদি থেকে নিয়েছে বর্ণিত বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গি এবং রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত প্রভৃতি সংস্কৃত থেকে অনূদিত হয়েছে আমাদের ভাষায়।এভাবেই আমাদের লিখিত বা শিষ্ট বাংলা ভাষাসাহিত্যের বুনিয়াদ নির্মিত হয়েছিল।
সংস্কৃতে রচিত রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ মধ্যযুগের বাংলা কাব্যকে ক্লাসিক মহিমা এনে দিয়েছে। গুপ্তযুগ থেকেই বাংলাদেশের সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার, পৌরাণিক সংস্কার সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে দৃঢ়মূল হয়েছে। বৌদ্ধ পালরাজাদের মধ্যে আর্যশাস্ত্র-সংহিতা, পুরাণ-মহাকাব্যের প্রতি আনুকূল্য লক্ষ করা যায়।
বাংলা ইসলামি শাসন কায়েম হলে অনেক পাঠান সুলতান হিন্দু কবি-পন্ডিতদের থেকে রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের গল্প শুনতে আগ্রহী হন ,অনুবাদ রচনায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। যেমন- রুকনুদ্দিন বরবক্ শাহ্ মালাধর বসুকে ভাগবতের অনুবাদ ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচনার জন্য ‘গুণরাজখাণ’ উপাধি দেন । চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁ ও তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ তাঁদের হিন্দু সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে দেন । সাহিত্য-অনুবাদের এই ধারার মাধ্যমে সমাজে অসাম্প্রদায়িক ঔদার্যের ছবিই ফুটে ওঠে এবং তা সমাজ-সংস্কৃতির পুনর্গঠনে বিশেষভাবে সহায়ক হয়।
রামায়ণ:
কৃত্তিবাস ওঝা :
বাংলা ভাষায় রামায়ণের প্রথম অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা। আনুমানিক ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়ায় শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবারে কৃত্তিবাসের জন্ম হয়। এঁদের উপাধি ছিল মুখোপাধ্যায়।
নিজের জন্মতিথি সম্বন্ধে কবি জানিয়েছেন-
“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্যমাঘ মাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।”
কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝার বাস ছিল পূর্ববঙ্গে। ১২ বছর বয়সে কৃত্তিবাস বিদ্যার্জনের জন্য উত্তর দেশে গিয়েছিলেন।
‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ ‘ হিসেবে প্রচলিত, জনপ্রিয় গ্রন্থটি শ্রীরামপুরের খ্রিস্টীয় যাজকেরা প্রথম মুদ্রিত করেন (১৮০২-০৩)। পরে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার দ্বিতীয় সংস্করণে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন (১৮৩০-৩৪)।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ পয়ার ত্রিপদী ছন্দে লেখা।
কৃত্তিবাস রাজা গণেশের রাজসভায় গিয়েছিলেন।
কৃত্তিবাসের মূল রামায়ণের অনুবাদকালে তাকে ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে রচনা করেছেন এবং কাব্যকায়াকে আধুনিক করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ । বহু শতাব্দীব্যাপী আপামর জনসাধারণের মধ্যে তাঁর কাব্যের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ রামায়ণের মূল চরিত্রগুলির মধ্যে বাঙালি সমাজের প্রক্ষেপণ, কাব্যে প্রতিফলিত বাংলার পরিবেশ ও প্রাত্যহিক জীবনচিত্র, ভক্তি ও করুণরসের সর্বজনগ্রাহ্যতা এবং সাধারণ মানুষের মননে সহায়ক পাঁচালির ঢঙ। গবেষকদের অনুমান পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কবি তাঁর এই কাব্য রচনা করেছিলেন।
রামায়ণের অনুবাদের ধারা :
🔵 পঞ্চদশ শতাব্দী :
কৃত্তিবাস ওঝা – শ্রীরাম পাঁচালি
মাধব কন্দলি – শ্রীরাম পাঁচালি
🔵 ষোড়শ শতাব্দী :
শঙ্কর দেব- শ্রীরাম পাঁচালি (উত্তর কাণ্ড)
🔵 সপ্তদশ শতাব্দী :
নিত্যানন্দ আচার্য :- অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ
রামশঙ্কর দত্ত:- রাম কথা
দ্বিজ অথবা পতিত ভবানীনাথ :- লক্ষ্মণ দ্বিগ্বিজয়
দ্বিজ শ্রীলক্ষণ :- অধ্যাত্ম রামায়ণ
চন্দ্রাবতী :- রামায়ণ
🔵 অষ্টাদশ শতাব্দী :
ফকির রাম কবিভূষণ :- অঙ্গদ রায়বার
রামচন্দ্র:- বিভীষণের রায়বার
রামনারায়ণ:-বিভীষণের রায়বার
কাশীরাম :- কালনেমির রায়বার
দ্বিজ তুলসী :- অঙ্গদ রায়বার
খোশাল শর্মা: – অঙ্গদ রায়বার
জগন্নাথ দাস:- লঙ্কাকাণ্ড
দ্বিজ দয়ারাম:- তরণীসেনের যুদ্ধ
কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী :- রামলীলা বা শ্রীরামমঙ্গল
রামানন্দ ঘোষ :- নূতন রামায়ণ বা রামলীলা। রামানন্দ ঘোষ নিজেকে ‘বুদ্ধবতার’ বলে প্রচার করেছেন।
দ্বিজ শিবরাম :- লক্ষ্মণ শক্তিশেল
উৎসবানন্দ:- সীতার বনবাস
জগৎরাম রায়:- অদ্ভুত রামায়ণ
🔵 উনবিংশ শতাব্দী :
রঘুনন্দন গোস্বামী : রামরসায়ন
কোচবিহাররাজ হরেন্দ্রনারায়ণ :রামায়ণ
কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণের অনুবাদে যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অনেকাংশেই বাল্মীকির প্রদর্শিত পথে না গিয়ে নিজ কল্পনা অনুসারে চরিত্র-চিত্রন ও ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বীরত্বের গরিমা প্রচার নয়, রাম চরিত্রের মাধুর্য বর্ণনাই তাঁর অন্বিষ্ট। তাঁর কাব্যের মূল সুর ভক্তি। বাঙালি হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা , জীবনাদর্শ, কল্পনা, সমাজ-ভাবনা, জীবন-অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বাঙালির নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মজীবনে তাঁর কাব্যের বিপুল প্রভাব লক্ষ করা যায় ।
চৈতন্যোত্তর যুগের রামায়ণের মধ্যে ‘অদ্ভুতাচার্যের রামায়ণ’ উল্লেখযোগ্য। পাবনা জেলার অমৃতকুণ্ডা গ্রামে ১৭ শ শতকের শেষভাগে আবির্ভূত সাঁতোলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি নিত্যানন্দ আচার্যের এই রচনা উত্তরবঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কবি ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ , ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’, ‘রঘুবংশম্’ থেকে তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। ইনি ছাড়া আর যাঁরা বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- কৈলাস বসু, দ্বিজ ভবানীদাস, দ্বিজ শ্রীলক্ষ্মণ চক্রবর্তী,কবিচন্দ্র প্রমুখ।