শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা
ভূমিকাঃ
আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ, বিজ্ঞান মনস্কতার যুগ। শিক্ষাই এযুগের প্রাণপ্রদীপ। শিক্ষাই সভ্যতার ধারক ও বাহক। শিক্ষাই পরিবেশকে দান করে শিষ্টাচার, সমষ্টিকে সমৃদ্ধ করে শৃঙ্খলা ও প্রজ্ঞায়। বস্তুত চিত্তের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করে শিক্ষা। কিন্তু সার্বজনীন শিক্ষার অভাবে সবকিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই গণশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। আর এই শিক্ষা বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার হল গণমাধ্যম।
গণমাধ্যম কী ?
ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মাস মিডিয়া; তাকেই আমরা বাংলায় বলি ‘গণমাধ্যম। যে মাধ্যমের ভিতর দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ হিসাবে অবসর বিনোদন করি, আনন্দ পাই, জ্ঞানলাভ করি এবং দেশ দেশান্তরের বহু খুঁটিনাটি খবর পেয়ে থাকি, তাকেই আমরা গণমাধ্যম বলব। এই মাধ্যমের সঙ্গে জনসাধারণের সরাসরি যোগাযোগ হয়ে থাকে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমঃ
আধুনিক জীবনের উপর গণমাধ্যমের প্রভাব সর্বব্যাপী। গণমাধ্যমগুলি দূরত্বের ব্যবধান ঘুচিয়ে পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। আধুনিক মানুষের হাতের কাছে আজ বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম রয়েছে । সেগুলির মধ্যে প্রথমেই যার কথা মনে আসে যেটি হল সংবাদপত্র। এছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে সুপরিচিত ও জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলি হলো- বেতার, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন, কম্পিউটার, যাত্রা, থিয়েটার ইত্যাদি।
শিক্ষা বিস্তারে সংবাদপত্রঃ
শিক্ষার প্রসারে ও নৈতিক মান-উন্নয়নে গণমাধ্যম হিসেবে আমরা প্রথমেই গ্রহণ করব খবরের কাগজকে। সকালবেলা ঘুম ভেঙে উঠলেই স্বদেশ এবং বিদেশের নানা সংবাদ নিয়ে নিয়মিত আমাদের সামনে এসে হাজির হয় সংবাদপত্র।পৃথিবীর নানা প্রান্তের খবরাখবরে আমাদের মনের পরিধি বিস্তৃত হয়, সমৃদ্ধ হয় আমাদের জ্ঞানভান্ডার। সংবাদপত্র শুধু সংবাদ পরিবেশন করে না, সংবাদের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বিষয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সাহিত্যচর্চায়, জ্ঞান ও শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করতে তথা শিক্ষা বিস্তারে সংবাদপত্রের ভূমিকা গুরত্বপূর্ণ।
শিক্ষাবিস্তারে বেতার:
খবরের কাগজের পরই গণমাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করা যায় রেডিওর কথা। বেতার যন্ত্রের আবিষ্কার বহু মানুষকে একসূত্রে বেঁধে দিতে সক্ষম হয়েছে। একইসঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষ একই অনুষ্ঠান শুনতে পায় বেতারে। বেতারে মনোরঞ্জনের পাশাপাশি নানা ধরনের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানও থাকে। বেতার শ্রুতিনির্ভর হওয়ায় নিরক্ষর মানুষও শুনে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। তাই শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বেতারের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
শিক্ষাবিস্তারে দূরদর্শনঃ
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যম হল দূরদর্শন। মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে যেমন এর জুড়ি নেই, তেমনি শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও এর দোসর মেলা ভার। টেলিভিশনে কেবল নিজের দেশের নয়, তামাম বিশ্বের ছবি আমাদের কাছে প্রতিদিন তুলে ধরছে। রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্য বা বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা ধারাবাহিক অনুষ্ঠান আমাদের মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শনিষ্ঠা, চরিত্রগঠন প্রভৃতি শিক্ষা দান করে। কলা, বিজ্ঞান, বানিজ্য বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য ও চিত্র সম্বলিত সজীব অনুষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠে। তাই গণমাধ্যম হিসাবে দূরদর্শনের জনপ্রিয়তা এখন সর্বাধিক।
শিক্ষাবিস্তারে চলচ্চিত্রঃ
চলচ্চিত্র বিজ্ঞানের আর-এক বিস্ময়কর অবদান। লোক-শিক্ষা ও লোকরঞ্জনের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের ভূমিকাও অতুলনীয়। চরিত্রগঠনে, নীতিশিক্ষা দানে, সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চায়, সাংস্কৃতিক বোধ সৃষ্টিতে চলচ্চিত্রের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
শিক্ষাবিস্তারে কম্পিউটার :
আধুনিক যুগযন্ত্র ও নগর সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কম্পিউটার। শিক্ষাবিস্তারে এই গণমাধ্যমটির ভূমিকা অপরিসীম।কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সাহায্যে আজ আমরা ঘরে বসেই অনেক তথ্য পেয়ে যাই। রেখাচিত্র অঙ্কনে, চিঠিপত্র ও বই লেখায় এই যান্ত্রিক ব্যবস্থাটির সাহায্য নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কর আবিষ্কারটিকে ।
গণমাধ্যমের গুরত্বঃ
জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হল গণমাধ্যম। এই গণমাধ্যমগুলির মধ্যে সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন, কম্পিউটারের গুরুত্ব বোধহয় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি।সংকীর্ণ গণ্ডীর কূপমন্ডুক জীবনে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পাড়ে, জীবনের বৈচিত্র্য যার হারিয়ে, বিশ্বের সবকিছু তার কাছে থেকে যায় অজ্ঞাত। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, জনমত গড়ে তোলা এবং জ্ঞানের বিস্তারের জন্য গণমাধ্যম গুলির সুষ্ঠ ব্যবহার একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
উপসংহার:
আজ আমাদের চারপাশে যেসব গণমাধ্যম রয়েছে সেগুলি শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগী। শুধু লোকশিক্ষা নয় প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্রেও এই গণমাধ্যম গুলি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। তবু বলা যায় সংবাদপত্র, বেতার এবং দূরদর্শনের মতো গণমাধ্যম যদি শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে আরও বেশি দায়িত্বশীল হয়, যদি আরও বেশি আকর্ষনীয় করে তুলতে পারে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানগুলিকে, তাহলে তা শিক্ষাবিস্তারে যুগান্তর এনে দিতে পারে। গণমাধ্যমগুলির কাছে আমরা আজ এই প্রত্যাশা করি।