বাংলা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস :
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নোত্তর :
১) ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ গ্রন্থে চর্যাগানের মোট সংখ্যা –— ৫১ । বাংলা গানের আদি নিদর্শন — চর্যাপদ।
২) চর্যার যুগে সঙ্গীতে কয়টি অঙ্গ দেখা যায় ?——-৬ টি
৩) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে মোট কতগুলি রাগ রাগিণীর ব্যবহার দেখা যায় ? –—— ৩২ টি
৪) মঙ্গলকাব্য গুলি গাওয়া হোতো কোন লৌকিক ছন্দে ?——- লাচাড়ি ছন্দে
৫) বাংলায় সর্ব প্রথম ধ্রুপদ রচনা করেন- –রামশঙ্কর ভট্টাচার্য
৬) মনসাগীতি রাঢ় বঙ্গে কী নামে পরিচিত ? – ঝাপান
দক্ষিণবঙ্গে ——- ভাসান । পূর্ববঙ্গে ——– রয়ানী । উত্তরবঙ্গে ——–সাইটোল বিষহরীর গান
৭) ‘ঝুমুর’ কী ধরনের গান ? –লোকগীতি
৮) দাশরথি রায় যে ধারার গানের রচয়িতা – পাঁচালী
৯) ‘গম্ভীরা’ মূলত কোন জেলার গান ? – মালদহ
১০) শাক্ত সঙ্গীতের প্রথম ও প্রধান কবি কে ? ——রামপ্রসাদ (উপাধি –কবিরঞ্জন)
১১) ‘টপ্পা’ গানের প্রচলন করেন- — নিধিবাবু
১২) একজন আখড়াই গানের শিল্পী হলেন –—-রামনিধি গুপ্ত
১৩) ‘ঠুংরি’ গানের প্রবর্তক হলেন – নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ
১৪) পাঁচালী ও কথকতারীতির সঙ্গে কীর্তন গানকে মিশিয়ে তৈরি হয়েছিল – ঢপ কীর্তন । ঢপ শব্দের অর্থ– শুদ্ধ সৌষ্ঠবসম্পন্ন।
১৫) মাঝিমল্লার গানকে কী বলা হয়– ভাটিয়ালি
১৬) পক্ষী দলের সবচেয়ে বিখ্যাত সদস্য বা গায়ক ছিলেন – রূপচাঁদ পক্ষী বা গৌরহরি দাস মহাপাত্র
১৭) সঙ্গীত শিল্পী মান্না দের প্রকৃত নাম কী ? – প্রবোধ চন্দ্র দে । ১৯৪২ সালে ” তমান্না” ছবিতে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
১৮) বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমারের প্রকৃত নাম কী ? – আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
১৯) ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি কার লেখা? —-আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী
২০) বাংলা তথা ভারতের প্রথম প্রাদেশিক ভাষার ব্যান্ড কোনটি ? – মহীনের ঘোড়াগুলি । দলনেতা—গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
২১) ভাওয়াইয়া গানের বাদকদের কী নামে ডাকা হয় ? – বাউদিয়া ।
২২) ভাটিয়ালি গানের উদ্ভব হয়েছিল – অবিভক্ত বাংলায়। জারি শব্দের অর্থ — ক্রন্দন।
২৩) বাংলা ভাষায় গজল রচনার পথিকৃত হলেন – অতুল প্রসাদ সেন
২৪) গণসংগীতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী সলিল চৌধুরি ছিলেন একজন _ সুরকার। তিনি “কয়্যার” সঙ্গীতের প্রবর্তক। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়ারের জয়যাত্রা শুরু হয় কার নেতৃত্বে – রুমা গুহঠাকুরতার।
২৫) অপেরা গানের প্রধান প্রচারক — মনোমোহন বসু।
২৬) ব্রতচারী গানের জনক _ গুরুসদয় দত্ত
২৭) বলো বলো বলো সবে – গানটি লিখেছেন– অতুলপ্রসাদ সেন। এছাড়াও–উঠগো ভারতলক্ষ্মী, হও ধরমেতে ধীর, মোদের গরব মোদের আশা। তুমি নির্মল কর—- রজনীকান্ত সেন।
২৮) জুড়ির গান প্রবর্তন করেন—– মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়।
২৯) ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন —- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩০) আমরা করব জয় ( We shall overcome) গানের রচয়িতা—– শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাঙালির চিত্রকলা :
১) বাংলার প্রাচীনতম ছবির নিদর্শন —- অষ্টসহস্রিকা- প্রজ্ঞাপারমিতা। ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পাল আমল।
২) নন্দলাল বসু যাঁর গ্রন্থে একেছেন , তিনি হলেন—-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সহজপাঠ)
৩) বাংলা লোকসাহিত্যে বিশেষভাবে বিকশিত চিত্র হল – পটচিত্র
৪) অস্বচ্ছ জলরঙের আঁকা ছবিকে বলে — গুয়াশ।
৫) তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহের ছবি এঁকেছেন—-চিওপ্রসাদ ভটাচার্য
৬) ” পট ” শব্দটির আভিধানিক অর্থ কী—– ছবি। কালীঘাট পট —উনিশ শতক।
৭) কলকাতায় প্রথম আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয় কার উদ্যোগে——হেনরিহোভার লক
৮) ” কলাভবন ” প্রতিষ্ঠাত করে কাকে রবীন্দ্রনাথ তার আর্চায করে নিয়ে আসেন— নন্দলাল বসু
৯) রবীন্দ্রনাথের ” সহজ পাঠ ” গ্রন্থের অলংকরণ করেন——নন্দলাল বসু
১০) চলমান গান্ধীজি কে লাঠি হাতে সাদা – কালোয় এঁকেছিলেন—- নন্দলাল বসু
১১) কৃষ্ণলীলা’ চিত্রকলার সিরিজ তৈরি করেন- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১২)পাশ্চাত্য রীতিতে চিত্রকলা শিক্ষার সূচনা হয়- –কলাভবনে
১৩) নন্দ লাল বসুর একজন কৃতী ছাত্র হলেন- –বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়
১৪) ভারতমাতা , অন্তিম শয্যায় শাহজাহান, কচ ও দেবযানী, অশোকের রানি, কাজরী নৃত্য–ছবিগুলি অঙ্কন করেছেন – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
১৫) মেকানিক্যাল ইন্সটিটিউট —- ১৮৩৯ সাল।
১৬) ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন শিল্পী —– গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৭) পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে খেলাচ্ছলে ছবি আঁকেন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (পূরবী কাব্যে)
১৮) বিশ্বভারতীর হিন্দি ভবনের দেওয়ালে আঁকা চিত্র — বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। ছবিটি “মধ্যযুগের সন্তান” নামে পরিচিত। ৭৭ ফুট বিস্তৃত, ৮ ফুট চওড়া।
১৯) তরমুজ রসিক, বাবু, বড়ে গোলাম আলী ছবিগুলি আঁকেন — পরিতোষ সেন।
২০) “পদ্মায় সূর্যাস্ত” — গোবর্ধন আশ। “মা যশোদা”– সুনয়নী দেবী। ” হাটের পথে”— রামকিঙ্কর বেইজ।
বাংলা চলচ্চিত্রের কথা
১)সিনেমা প্রথম তৈরী হয় – ফ্রান্সে
২) বাংলায় সর্বপ্রথম নির্বাক চলচিত্র – রাজা হরিশচন্দ্র।
৩) বাংলায় সবাক ছবির যুগ শুরু হয়- —১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।
৪) প্রথম বাংলা সবাক ছবি — জামাইষষ্ঠী। হিন্দিতে– আলম আরা।
৫) ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম তথ্যচিত্রকার — হীরালাল সেন।
৬) সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি – পথের পাঁচালি । মুক্তি পায় — ১৯৫৫ সালে।
৭)সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন- -পণ্ডিত রবিশঙ্কর
৮) রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার নাম—-চারুলতা
৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে নাটকটিকে চলচ্চিত্রায়িত করেন —- নটীর পূজা।
১০) ‘ভুবনসোম’ সিনেমাটির পরিচালক হলেন- মৃণাল সেন
১১)ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি — নাগরিক। এছাড়াও মেঘে ঢাকা তারা, তিতাস একটি নদীর নাম, অযান্ত্রিক।
১২) প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যৈর সবাক বাংলা কাহিনী চিত্র– বিল্বমঙ্গল
১৩) উওম– সুচিত্রা জুটির প্রথম ছবির নাম কী– সাড়ে চুয়াত্তর। পরিচালক—- নির্মল দে।
১৪) ” উদয়ের পথে ” ‘ দো বিঘা জমিন ‘ চলচিত্র দুটির পরিচালক কে – বিমল রায়
১৫) মৃণাল সেনের প্রথম ছবি কী – রাতভোর। এছাড়া — নীল আকাশের নীচে, ভুবন সোম (হিন্দি)
১৬) ” কাবুলিওয়ালা ” ছবির পরিচালক—- তপন সিংহ। এছাড়া —হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, সাগিনা মাহাতো, সবুজ দ্বীপের রাজা, বাঞ্ছারামের বাগান।
১৭) বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জীবন অবলম্বনে তৈরি তথ্যচিত্র — The Inner Eye. (সত্যজিৎ রায়)
১৮) রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি —-হীরালাল সেন ও মতিলাল সেন।
১৯) সিনেমা ও পরিচালক ——- ছিন্নমূল– নিমাই ঘোষ। সাড়ে চুয়াত্তর ——- নির্মল দে। পলাতক, বালিকা বধূ——- তরূণ মজুমদার। পরিবর্তন ——সত্যেন বসু। দেবদাস (১৯৩৫) —– প্রমথেশ বড়ুয়া।
ভুলি নাই —– হেমেন গুপ্ত। নতুন ইহুদি—- সলিল সেন
২০) প্রথম রঙিন ছবি —— পথে হল দেরি। (বিভূতি লাহা)
বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা
১)বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন — সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন– সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে।
৩) ‘বেঙ্গল ক্যামিক্যালস’ এর প্রতিষ্ঠাতা–প্রফুল্লচন্দ্র রায়
৪) ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কালটিভিশন অফ সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা কার কীর্তি- –মহেন্দ্রলাল সরকার
৫) জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলায় বিখ্যাত গ্রন্থ হল— অব্যক্ত
৬) ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন— জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৯১৭সালে।
৭) ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনসটিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন- –প্রশান্তচন্দ্র মহনানবিশ
৮)‘বাঙ্গালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যাবহার’ গ্রন্থের লেখক কে – প্রফুল্লচন্দ্র রায়
৯) এদেশে প্লাস্টিক সার্জারির জনক — ডা. মুরারিমোহন মুখোপাধ্যায়।
১০) রাধানাথ শিকদার ছিলেন– হিন্দু কলেজের ছাত্র
১১) আমাদের দেশে প্রথম বাস্পীয় ইঞ্জিন নিমার্ণ করেন– গলোকচন্দ্র নন্দী
১২) ” বেঙ্গল কেমিক্যালস ” –এর প্রতিষ্ঠাতা– প্রফুল্লচন্দ্র রায়
১৩) কাকে ” ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনক ” বলা হয় – উইলিয়াম রকসবাগ
১৪) ” এশিয়াটিক সোসাইটির ” প্রাণ পুরুষ ছিলেন– উলিয়াম জোনস
১৫) সর্ব প্রথম বাংলা মুদ্রা অক্ষর খোদাই করেন– পঞ্চানন কর্মকার
১৬) The Upper Atmosphere ” গ্রন্থের লেখক– শিশির কুমার মিত্র
১৭) প্রথম ভারতীয় দূরবীন নির্মাতা – নগেন্দ্রনাথ ধর
১৮) ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ গ্রন্থের রচয়িতা — গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।
১৯) Auxiliary Table গ্রন্থটি রচনা করেন- চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য
২০) প্রথম পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়— ১৮৮৬ সালে।
বাঙালির ক্রীড়াসংস্কৃতি
১) ‘ক্রিকেট খেলা’ বইটির লেখক — সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী ( বাংলা ক্রিকেটের জনক) ।
২) ‘গোল’ বইটির লেখক — ধ্যানচাঁদ (হকির জাদুকর)।
৩)প্রথম বাঙালি সাঁতারু – মিহির সেন । বুলা চৌধুরী যে খেলার সাথে যুক্ত— সাঁতার
৪) ভারতবর্ষে হকি ক্লাবটি গড়ে উঠেছিল – কলকাতায়
৫) যতীন্দ্রচরণ গুহ (গোবর গুহ) কোন খেলার সঙ্গে যুক্ত –কুস্তি
৬) গোষ্ঠ পাল যে খেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন— ফুটবল
৭) মোহনবাগান ক্লাব–১৮৮৯. ইস্টবেঙ্গল ক্লাব –১৯২০.
৮) কোন বাঙালি ভারতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ও বিখ্যাত ক্রিকেটার – সৌরভে গঙ্গোপাধ্যায়
৯) ভারতীয় ফুটবল খেলার ইতিহাসে এক চিরস্মরনীয় ব্যক্তিত্ব হলেন – নগেন্দ্র প্রসাদ
১০) শিলিগুড়ির টেবিল টেনিসের দ্রোণাচার্য বলা হয় —- ভারতী ঘোষকে।
২। অনধিক একশো পঞ্চাশ শব্দে যে- কোন দুটি প্রশ্নের উত্তর দাও । ৫x২=১০
বাংলা গানের ধারা
১। বাংলা গানের ধারায় রবীন্দ্রনাথ
বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠাকারী বিশ্ববরেণ্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা গানের জগতেও তিনি একটি মাইলফলক বিশেষ। তিনি গানের রাজা। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, শিল্পী এবং সংগীত বিশারদ। আনুমানিক ২২৩২ টি গান তিনি রচনা করেছিলেন, যেগুলি ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের গানকে প্রেম, পূজা, প্রকৃতি, স্বদেশ প্রভৃতি পর্যায়ভুক্ত করলেও সুর ও বাণীর দিক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ।
১. ধ্রুপদ ও ধামার :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট ৭৭ টি ধ্রুপদ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – ‘প্রথম আদি তব শক্তি’ , ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’ প্রভৃতি ।
২. খেয়াল ও ঠুংরি :
হিন্দি খেয়াল অনুসরণে উচ্চাঙ্গসংগীত ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা প্রায় ৩০০ গান সৃষ্টি করেন। তাঁর লেখা দুটি খেয়াল হলো – ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ , ‘অনেক দিয়েছ নাথ’। ঠুংরির মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও’।
৩. টপ্পা :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দি টপ্পা অনুসরণে ১৪ টি এবং নিজস্ব শৈলীতে ২৫টি টপ্পা গান রচনা করেছেন। যেমন- ‘তবু মনে রেখো’, ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ প্রভৃতি ।
৪. লোকসংগীত :
রবীন্দ্রনাথের বহু গানেই লোকসংগীতের ছায়া পড়েছে । ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, ‘মেঘের কোলে কোলে’ প্রভৃতি লোকসংগীত আজও সমান জনপ্রিয় ।
৫. ভাঙা গান :
হিন্দি এবং অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সকল গান রচনা করেছিলেন সেগুলি ভাঙা গান নামে পরিচিত । যেমন ‘বড় আশা করে’ , ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ প্রভৃতি।
বিষয় ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে রবীন্দ্রসংগীতকে নানা ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
আধ্যাত্মিক সংগীত : ‘অন্তর মম বিকশিত করো’
প্রেম সংগীত : ‘আমি তোমারই সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’
দেশাত্মবোধক : ‘জন গন মন’, ‘আমার সোনার বাংলা’
শিশু সংগীত : ‘মেঘের কোলে রোদ এসেছে’
ঋতু ও প্রকৃতি বিষয়ক : ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি’।
২। বাংলা গানের ধারায় কাজী নজরুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা গানের দিক পরিবর্তনের সবচেয়ে বড়ো কান্ডারির ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। মাত্র ১৪ বছরে তিনি অসংখ্য গান রচনা করেন, যে গানগুলি কালকে অতিক্রম করে সুরে ও কথায় আজও বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ আসন লাভ করেছে । রোমান্টিকতার চরম স্পর্শে তার গানগুলি সিক্ত। নজরুল ইসলামের গানে বিষয়ের যে বৈচিত্র্য তা অন্য কারো গানে নেই। তাঁর গানগুলিকে কয়েকটি পর্যায় ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
প্রেম ও প্রকৃতি :
নজরুলের অধিকাংশ গানেরই বিষয় ভাবনায় প্রেম ও প্রকৃতিই প্রধান । ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি’ এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
ঋতু সংগীত :
নজরুলের বহু গানেই ঋতুর প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন ‘বর্ষা ঋতু এল বিজয়ীর সাজে’।
রাগাশ্রয়ী গান :
বিভিন্ন রাগ রাগিনী ব্যবহার করে নজরুল অসংখ্য গান রচনা করেছেন। যেমন ‘দোলন চাঁপা বনে দোলে’, ‘অঞ্জলি লহ মোর’।
গজল :
আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে তৈরি নজরুলের লেখা গজল গুলিও রসসিদ্ধ হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ‘বাগিচায় বুলবুল তুই’ স্মরণীয়।
ইসলামি গান :
বিখ্যাত লোক সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমেদের অনুরোধে নজরুল ইসলাম রচনা করেন বিখ্যাত ইসলামি সংগীত ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’।
শ্যামা সংগীত :
নজরুলের রচনায় শ্যামা সংগীত গুলি আজও বাঙালি জনসাধারণ তাদের মনের মন্দিরে রেখে দিয়েছে। যেমন ‘বল রে জবা বল’।
স্বদেশী সংগীত :
নজরুলের লেখা স্বদেশী গান গুলি বাংলার বিদ্রোহীদের বুকে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল,ইংরেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তাঁর লেখা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ,’শিকল পরা ছল’।
পরিশেষে বলা যায়, বাণী আর সুরের বৈচিত্র্যে, নিত্য নতুন রাগ ও তাল উদ্ভাবনে ও প্রয়োগে, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ও লোকাসুরের অনুসরণে অপ্রচলিত রাগ-রাগিনীর ব্যবহারে নজরুল ইসলাম বাংলা গানের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসনের মালিক হয়ে আছেন।
৩। বাংলা সংগীতের ধারায় অতুলপ্রসাদ সেন
বাংলা সংগীতের জগতে অতুলপ্রসাদ সেনের অবদান অনস্বীকার্য । অতুলপ্রসাদ সেন একাধারে সংগীতজ্ঞ,গীতিকার এবং শিল্পী ছিলেন । তাঁর লেখা গানগুলি ‘কাকলি’ , ‘কয়েকটি গান’ ও ‘গীতগুঞ্জ’ – এই তিনটি বইয়ে সংকলিত হয়েছে । তাঁর রচিত গানগুলিকে ৫টি শ্রেণিতে ভাগ করে আলোচনা করা যায় ।
রাগাশ্রয়ী গান :
বাণী, কাব্য ,ছন্দ ও সুরের চলন – গানের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সংগতি রেখে রাগ মিশ্রণের ফলে তাঁর রাগাশ্রয়ী গানগুলি অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছে । ‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে’, ‘যাব না যাব না যাব না ঘরে’ ইত্যাদি ।
টপ্পা ঠুংরি :
বাংলা ভাষায় গজল রচনায় অতুলপ্রসাদ সেন পথিকৃৎ ছিলেন। ‘কে গো তুমি বিরহিণী’ , ‘জল বলে চল’ প্রভৃতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। অতুলপ্রসাদের টপ্পা ঠুংরি রচনাগুলিতে উত্তরপ্রদেশের কাজরী ও লগনী গানের প্রভাব পড়েছিল।
স্বদেশী সংগীত :
অতুলপ্রসাদের ‘উঠো গো ভারত লক্ষ্মী’, ‘বল বল বল সবে’, ‘হও ধরমেতে ধীর’ প্রভৃতি সংগীত আজও সমান জনপ্রিয়।
ঋতু সংগীত :
অতুল প্রসাদের বহু গানেই প্রকৃতি ও বিভিন্ন ঋতুর সার্থক চিত্রায়ন রয়েছে । আইল আজি বসন্ত মরি মরি’, ‘বন দেখে মোর মনের পাখি ডাকল গো’ এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় ।
অন্যান্য :
উপরোক্ত শ্রেণি ছাড়াও অতুলপ্রসাদ বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালি দেশজ সুরে বহু গান রচনা করেছেন।
৪। বাংলা গানের ধারায় রজনীকান্ত সেন
বাংলা সংগীত জগতে ‘কান্ত কবি’ নামে পরিচিত কবি রজনীকান্ত সেন এক উল্লেখযোগ্য নাম । স্বল্পকালের জীবদ্দশায় তিনি অসংখ্য গান রচনা করে গেছেন । তাঁর গানে হিন্দুস্তানি মার্গ সংগীত এবং টপ্পা বাউল কীর্তন প্রভৃতি সুরের প্রভাব দেখা যায়। রজনীকান্তের গানগুলি মোটামুটি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ।
ভক্তিগীতি :
ভক্তিগীতি রজনীকান্তের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি । ঈশ্বরের ভক্তিতে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ । এই পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য গান হল – তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়েমুছায়ে’। বাণী সুর ভাব কাব্যমাধুর্য স্বকীয়তা এবং সহজ চলনে তাঁর লেখা ভক্তিগীতিগুলি বাংলা গানের ভুবনে বিশিষ্ট হয়ে আছে।
স্বদেশী সংগীত :
দেশাত্মবোধক সংগীতেও তিনি অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য গান হল ‘নমো নমো নমো জননী বঙ্গ’, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ প্রভৃতি ।
হাস্যরসাত্মক গান :
রজনীকান্ত সেন বেশ কিছু হাস্যরসের গন রচনা করেছিলেন । এই পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য গান হল ‘যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে রত পানতোয়া শত শত’।
রজনীকান্ত সেন বাংলা গানের এক নতুন দিগন্তের পথপ্রদর্শক। রজনীকান্ত সেনের গান সম্পর্কে মাননীয় শম্ভুনাথ ঘোষ মহাশয় বলেছেন – ‘নিরাবরণ মাধুর্য এবং করুণ রসের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগই তাঁর গানের উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য ।” এই কারণে তার গান সবার কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য।
৫। বাংলার লোকসংগীত
লোকসংগীত সঙ্গীত রাজ্যের একটি অন্যতম ধারা ।এটি মূলত বাংলার নিজস্ব সংগীত । গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের সুখ দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সংগীতে। লোকসংগীত বাংলা গানের মূল চালিকাশক্তি। এই গানে প্রকৃতি ও মানুষের রূপ-রস-গন্ধ বর্তমান । এই গানের ভাষা কথ্য আঞ্চলিক ।
বৈশিষ্ট্য :
- মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত।
- সম্মিলিত বা একক কণ্ঠে গীত হতে পারে।
- সাধারণত নিরক্ষর মানুষের রচনায় এবং সুরে এর প্রকাশ ঘটে ।
- আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চারিত হয় ।
- প্রকৃতির প্রাধান্য বেশি ।
- দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রকাশ পায় ।
লোকসংগীতের ধারা :
বাংলা লোকসংগীতগুলির মধ্যে যে গানগুলির নাম প্রথমেই করতে হয় সেগুলি হল বাউল, ভাটিয়ালি, সারি, কবিগান, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, ঝুমুর ইত্যাদি ।
বাউল গান :
বাংলা সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকসংগীত বাউল গান। বাউল গানের মূল বিষয়বস্তু প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা, দেহতত্ত্ব, দর্শন প্রভৃতি । বাউলরা মুখে মুখে গান বাঁধেন । একতারা বাজিয়ে বাউল গান গাওয়া হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতেও বাউল গানের প্রভাব যথেষ্ট। লালন ফকির বাউল গানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ।
ভাটিয়ালি :
ভাটিয়ালি হল মূলত মাঝি-মাল্লাদের গান। নদীতে নৌকা বাইতে বাইতে মাঝিরা একান্তভাবে একলাই এই গান গেয়ে থাকে। ব্যক্তি হৃদয়ের আবেগঘন উচ্ছ্বাস, গভীর অনুভব, তত্ত্ব জিজ্ঞাসা এই গানে ফুটে ওঠে । কোনো বাদ্যযন্ত্র নয় সুর আর কন্ঠই এই গানের অবলম্বন। আধুনিক সময়ের জসীমউদ্দীন এবং আব্বাসউদ্দিন আহমেদ ভাটিয়ালি গানকে জনপ্রিয় করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।
সারি গান :
সারিবদ্ধ ভাবে একত্রে কাজ করতে করতে যে গান গাওয়া হয় তাকে সারি গান বলা হয় । সাধারণত নৌকার মাঝি মাল্লারা একযোগে নৌকা বাইতে বাইতে এই গান গায়। রাধা-কৃষ্ণ, শিব-পার্বতী ,লৌকিক নায়ক-নায়িকার প্রেম কাহিনি ইত্যাদিই এই গানের বিষয়।
কবিগান :
মুখে মুখে ছড়া কেটে সুর দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে কবিগান গাওয়া হয়। সাধারণত দুজন ব্যক্তি বা দলের মধ্যে কবির লড়াই জমে ওঠে। কবিগান শিখতে হলে দীর্ঘদিনের তালিমের প্রয়োজন । পূর্বে ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি কবিয়ালদের মতো শিল্পীরা আসরেই গান বাঁধতেন। প্রধান শিল্পীদের সঙ্গে যারা গানে সঙ্গ দেন তাদের বলা হয় দোহার।
গম্ভীরা :
উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে মালদা জেলার অন্যতম জনপ্রিয় লোকসংগীত হলো গম্ভীরা। অবশ্য গানের পাশাপাশি এতে নাচের পরিবেশনও হয়। মূলত চৈত্র মাসে চড়ক উৎসবের সময় শিবের মহিমা কীর্তন প্রচার করা হয়।
৬। বাংলা গানের সলিল চৌধুরীর অবদান
বাংলা গানের জগতে নতুন পথের দিশারী হিসেবে সলিল চৌধুরী একটি উল্লেখযোগ্য নাম । তিনি প্রথমত তার গানের তরী ভাসিয়েছিলাম গণসংগীতের স্রোতে। তিনি যেমন একাধারে কথাকার ,সুরকার ,গায়ক ছিলেন তেমনি ছিলেন সংগীত পরিচালকও। প্রথম জীবনে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর গানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উভয় প্রভাবই দেখা যায় ।
সলিল চৌধুরী উঁচু থেকে নীচু সব শ্রেণির মানুষকে দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে । মাটির কাছাকাছি যেসব মানুষ থাকেন তাদের সঙ্গে মিশেছেন নিজের গরজে। ফলে তার গানে যেসব সুর এসেছে তাতে মিশে আছে মাটির সোঁদা গন্ধ, বাঁশির মিঠে সুর, আধপেটা খিদের জ্বালা, আজীবন বঞ্চনার প্রতিবাদ ।
সুদীর্ঘ সংগীত নির্দেশনার জীবনে সলিল চৌধুরী ৭৫ টি হিন্দি ছবিতে, ৪০ টি বাংলা ছবিতে ,অন্তত ২৬টি মালায়ালাম ছবিতে, বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ছবিরও সংগীত পরিচালনা করেন । ১৯৪৯ এ ‘পরিবর্তন’ ছবির সংগীত পরিচালক রূপে চলচ্চিত্র জগতে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫৩ সালে ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির সূত্রে হিন্দি ছায়াছবির দুনিয়ায় তিনি পা রাখেন।
সলিল চৌধুরীর সংগীত পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবিগুলি হল বাঁশেরকেল্লা, বাড়ি থেকে পালিয়ে, গঙ্গা, কিনু গোয়ালার গলি, লাল পাথর, রক্তাক্ত বাংলা, অকালের সন্ধানে, হারানের নাতজামাই প্রভৃতি। হিন্দি ছবির মধ্যে জাগতে রহো, মুসাফির, মধুমিতা, পরখ ,হাফ টিকিট ,আনন্দ ,মৃগয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সলিল চৌধুরী ‘কয়্যার’ সংগীতের প্রবর্তক। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ব্যবহারে নানা উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখান তিনি । ‘বোম্বে ইয়ুথ কয়্যার’ প্রতিষ্ঠা করেন । গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে কোরাস গায়ন পদ্ধতি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সৃষ্টি করেন ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে’, ‘মানব না বন্ধনে’ , “আমার প্রতিবাদের ভাষা’ প্রভৃতি কালজয়ী গান ।
পরিশেষে বলা যায় সলিল চৌধুরীর প্রতিভা ও অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন আজও হয়নি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের পর এমন নানামুখী ও বিচিত্রকর্মা সংগীতপ্রতিভা বাংলা গানের জগৎ বিশেষ পায়নি।
বাঙালির চিত্রকলা
১। বাংলার চিত্রকলার ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিত্রকলার জগতে ইউরোপীয় রীতির পাশাপাশি ভারতীয় শিল্পীদের যে বিরাট ভূমিকা থাকতে পারে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতে তা প্রথম প্রকাশিত হয়। তিনি হলেন ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ। নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতির জনকও তিনি । তিনি হলেন প্রথম ভারতীয়, যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী।
অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ শুরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তাঁর কাছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। পরবর্তীতে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তাঁর আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই কৃষ্ণলীলা সিরিজ থেকেই ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার জয়যাত্রা শুরু হয়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান দক্ষতা ছিল জলরঙে, ‘ওয়াশ’ পদ্ধতিতে চিত্র রচনায়।ওয়াশ পদ্ধতিতে চিত্র রচনার ফলে তাঁর ছবিতে ব্যবহৃত রঙের চরিত্র হয়ে উঠল পেলব ও মৃদু।দৃশ্যমান জগতের চেয়ে অনুভূতির জগৎ প্রাধান্য পেল। তাঁর শাজাহানের অন্তিমকাল মোঘল মিনিয়েচারের এক লোকায়ত নিরীক্ষা,যেখানে শাজাহানের অন্তিম সারবত্তা করুণ রসের। ক্রমান্বয়ে আকঁলেন বুদ্ধ ও সুজাতা (১৯০১), কালীদাসের ঋতুসংহার বিষয়ক চিত্রকলা (১৯০১), ভারতমাতা(১৯০৫), কচ ও দেবযানি (১৯০৬), শেষযাত্রা (১৯১৪)। জাপানি প্রভাবে অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কন করেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওমর খৈয়াম (১৯৩০)চিত্রাবলি। চিত্রসাধনের শেষ পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা নতুন মাত্রা লাভ করে। গড়ে তোলেন কুটুম কাটাম – আকারনিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপসৃষ্টি।
২। রামকিঙ্কর বেইজ
ভারতীয় শিল্পকলা চর্চায় আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে রামকিঙ্কর বেইজ অন্যতম। রামকিঙ্কর বেইজ, আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক ও বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তাঁর শিল্প সৃষ্টির মূলে আছে দলিত এবং আদিবাসীর জীবনাচরণ । প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। তিনি তেল রং ও জল রঙের ছবি এঁকেছেন । ছবিগুলো প্রধানত প্রকৃতি কেন্দ্রিক।
ভারতীয় ভাস্কর্যের চরিত্র নির্মাণে রামকিঙ্করের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি তাঁর শিল্পকর্মে সাঁওতালদের জীবন ও কর্মের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন পাশ্চাত্য প্রকাশবাদী ঢঙে। তার ভাস্কর্য ও চিত্রকলার কোনোটিই তার সময়ের প্রচলিত ভারতীয় রূপরীতির অনুসারী নয়। সেগুলো তার নিজস্ব ভাবনার ঋদ্ধ প্রকাশ। শহরের আকর্ষণ ছেড়ে দূরে উত্তর কলকাতায় শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন প্রায় সারাটা জীবন। ওখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরা তার আগ্রহ কেড়ে নিয়েছিল। ছবি ও ভাস্কর্যে তিনি তাদের জীবনকে ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার চারপাশে সচল, প্রাণবন্ত মৃত্তিকালগ্ন এই জীবন-প্রবাহ তাকে সার্বক্ষণিক টানতো। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার দানবীয় শক্তি উভয়ই তিনি তার শিল্পকর্মে ভিন্নমাত্রায় তুলে ধরেছেন। তাইতো তার ছবিতে দেখতে পাই ধানমাড়াইরত গ্রামীণ নারী, সাঁওতাল উৎসব, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিত্রিত।
তাঁর শিল্পকর্ম ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। প্রথমদিকে রামকিঙ্কর ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অসহযোগ আন্দোলনের সংগ্রামীদের আবক্ষ চিত্র আঁকতেন। মানুষের মুখ, অভিব্যক্তি, তাদের শরীরের ভাষা নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করাতে তার আগ্রহ ছিল বেশি। আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প, প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় ধ্রুপদী চিত্রকর্ম তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়েও দেশের দীপ্ত মুখচ্ছবিকে সারা বিশ্বের কাছে উপহার দিয়েছেন এই সার্থক চিত্রশিল্পী।
বাংলার চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান অনস্বীকার্য । নন্দলাল বসু শৈশবকাল থেকেই চিত্রকলার প্রতি গভীর আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি কম বয়স থেকেই উৎসাহের মধ্য দিয়ে দেবদেবীর মূর্তি সহ পুতুল তৈরি করতেন । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় তিনি আর্টস্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান । এরপর থেকেই তাঁর চিত্রশিল্পের প্রতিভার প্রকাশ পায়।
অবনীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চায় ধ্রুপদী ও পৌরাণিক অতীত সম্পর্কে যে দ্বিধাহীন ঝোঁক ছিল তা থেকে সরে এসে তাঁর ছাত্র নন্দলাল বসু নিজের চারপাশের বহমান জীবনকে ছবির বিষয় করে তোলেন। গ্রামীণ প্রকৃতি সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন হয়ে উঠলো তার ছবির উপজীব্য। ১৯২০ সালে নন্দলাল শান্তিনিকেতনের কলাভবন স্থায়ীভাবে যোগদান করার পর থেকেই শিল্প শিক্ষার এক বৈশিষ্ট পদ্ধতি এই প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ভারতীয় শিল্পশিক্ষায় নন্দলালই সর্বপ্রথম আউটডোর স্টাডি বা নেচার স্টাডির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন ।
নন্দলাল বসুর হাতে প্রাধান্য পেয়েছিল প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ মূলক ছবি।
শান্তিনিকেতনের দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর , তার খোয়াই, মাঠে বিচরণরত মোষ, নারী-পুরুষ-শিশু, হাট যাত্রী পথিক, মালবোঝাই গরুর গাড়ি – এ সমস্তই উঠে এল তার ছবির বিষয় হিসেবে। নন্দলালের করার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠে’র অনবদ্য অলংকরণ প্রতিটি বাঙালির শৈশব স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। স্বদেশী ভাবনায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন নন্দলাল বসু । ১৯৩০ সালে ডান্ডি লবণ আন্দোলনে গান্ধীজির গ্রেফতারের পরে নন্দলাল সাদা-কালোয় লাঠি হাতে চলমান গান্ধীজিকে এঁকেছিলেন। এই চিত্রটি অহিংস আন্দোলনের আইকন বা প্রতীকে পরিণত হয় ।
নন্দলাল বসু অঙ্কিত বিখ্যাত ছবি হলো সতী, পার্থসারথি, হলকর্ষণ, রাঙামাটির পথ ,শোকার্ত সিদ্ধার্থ ,জগাই মাধাই প্রভৃতি । ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন।
বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বাংলার বিখ্যাত লোকচিত্র কালীঘাট পটচিত্র শিল্পকে বিশ্বনন্দিত করে তোলেন। তিনি নিজে পটুয়া না হলেও নিজেকে পটুয়া হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি পছন্দ করতেন।১৯১৮-১৯ থেকে তাঁর ছবি ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টের পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
বিদেশি ভাবধারায় প্রথম দিকে ছবি আঁকলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ দেশীয় তথা গ্রামবাংলার প্রতিরূপ তার ছবিতে ফুটে উঠেছে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার লক্ষ্যে তিনি লোক ও নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি বেছে নেন। নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাবধারার জন্য তিনি গর্বিত ছিলেন। তিনি বহুবার বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেলেও কখনও বিদেশে যাননি।-
“আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা, ওরা এসে আমাদেরটা দেখে যাক।”
বাংলার লোকজ পুতুল, শিশু, গ্রাম বাংলার সরল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখর চিত্র ইত্যাদি তিনি তার ছবির ‘ফর্ম’ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর ছবির বিষয় বৈচিত্র্য লক্ষ্যনীয়। তাঁর আঁকা ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য-সাঁওতাল জননী ও শিশু,মাদলবাদনরত সাঁওতাল,নৃত্যরত সাঁওতাল,মা ও শিশু,রাঁধাকৃষ্ণ,রাবণ,সীতা,জটায়ু, যীশু প্রভৃতি।
বাংলা চলচ্চিত্রের কথা
১। বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের অবদান
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ঠিক তেমনি বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের অবদান রয়েছে। সত্যজিৎ রায় ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে তর্কাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক রূপে পরিগণিত । উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৌত্র, সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায় শৈশব থেকেই সংস্কৃতির আঙিনায় বড়ো হয়েছেন।
সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা সত্যজিৎ রায়। চিত্রনির্মাণ কর্ম তাঁর জীবনের সঙ্গে যুক্ত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দুই কথাসাহিত্যিক তাঁর চিন্তা-চেতনার জগতকে ভাবিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সিনেমাটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক তথ্যসমৃদ্ধ চিত্রের সম্মান লাভ করে । ‘পথের পাঁচালী’ , ‘অপুর সংসার’ ও ‘অপরাজিত’ এই তিনটি সিনেমা বা অপু ত্রয়ী তাঁর জীবনের সেরা সৃষ্টি। এই তিনটি সিনেমা সত্যজিৎ রায়কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়ে ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বের সিনেমা মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছিল।
১৯৬৪ তে রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ সিনেমাটি পরিচালনা করেন । এই সিনেমায় চারুলতার একাকীত্ব আধুনিক কালের গৃহকর্ত্রীর মনোবেদনার সঙ্গে সমীকৃত হয়ে উঠেছে । এছাড়া মহানগর, তিনকন্যা ,অভিযান, কাপুরুষ মহাপুরুষ, জলসাঘর সমালোচকদের সপ্রশংস অভিনন্দন লাভে সমর্থ হয়। শিশু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে গুপী গাইন বাঘা বাইন ,হীরক রাজার দেশে ছাড়াও তাঁর নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দা কাহিনী অবলম্বনে সোনার কেল্লা , জয় বাবা ফেলুনাথ শিশু ও বয়স্কদের সমানভাবে মনোরঞ্জন করেছে। এছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য, শতরঞ্জ কী খিলাড়ি, ঘরে-বাইরে, গণশত্রু, আগন্তুক প্রভৃতি চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য চিত্র পরিচালনার ক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়। ১৯৯২ সালে সমগ্র সিনেমার প্রতি অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য সিনেমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অস্কার লাভ করেন।
বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক ঋত্বিক ঘটক খুব বেশি ছবি করেননি কিন্তু যে কয়েকটি ছবি তিনি করেছেন তা বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকরা মনে রাখবে। ১৯৫০ সালে নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল সিনেমায় অভিনেতা ও সহকারি পরিচালক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটে।
ঋত্বিক ঘটকের প্রথম সিনেমা নাগরিক ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলা সিনেমা ক্ষেত্রে নাগরিক একটি মাইলফলক রূপে পরিগণিত হয়ে থাকে । সমাজবাস্তবতার এমন সুনিপুণ চলচ্চিত্রায়ন ইতিপূর্বে এমন ভাবে আর দেখা যায়নি। ১৯৫৮ তে সুবোধ ঘোষের গল্প অবলম্বনে অযান্ত্রিক নির্দেশনা করেন যেখানে একটি যন্ত্র ও তার মালিকের অদ্ভুত মানবিক সম্পর্ক বন্ধনের চিত্র ধরা পড়ে।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) অন্যতম; এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যার মাধ্যমে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রুঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে। হিন্দু বাঙালি শরণার্থীর দুর্দশার কথা বলা হয়েছে।দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে তৈরি ঋত্বিকের একাধিক ছবিতে মর্মস্পর্শী সংলাপ ব্যবহার হয়েছে। সুবর্ণরেখার শুরুতেই শোনা যায় এমন সংলাপ ‘রাতে কোন যুবক ঘুমাবেন না’।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস অবলম্বনে তিতাস একটি নদীর নাম নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। পরের বছর তাঁর শেষ চলচ্চিত্র যুক্তি তক্কো গপ্পো প্রকাশিত হয়। এটি ঋত্বিক ঘটকের আত্মজৈবনিক ছায়াছবি এবং এর নায়ক নীলকন্ঠের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন পরিচালক স্বয়ং।
চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক মনেপ্রাণে মার্কসীয় আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করতে চাইলেও বামপন্থা এবং মানবতাকে তিনি কখনোই ত্যাগ করতে পারেননি। সমালোচকরা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা অতি নাটকীয়তা ও ভারসাম্যহীনতার কথা বললেও আজকের দর্শক জানেন অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা চলচ্চিত্র-প্রতিভা। আবেগে, মননে, সংলাপে,দৃশ্যের সংঘর্ষ নির্মাণে তাঁর সিনেমা সম্পূর্ণ অভিনব।
বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে স্বীকৃতি লাভ করেছেন যে কজন পরিচালক তাঁদের মধ্যে অন্যতম মৃণাল সেন। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি রাত-ভোর মুক্তি পায়। এই ছবিটি বেশি সাফল্য পায় নি। তার দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নিচে তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। তার তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবন থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান।
১৯৬৯ সালে তার পরিচালিত ছবি ভুবন সোম মুক্তি পায়। এই ছবিতে বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। তার কলকাতা ট্রিলোজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩) ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন। মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তার খুবই প্রশংসিত দুটি ছবি এক দিন প্রতিদিন (১৯৭৯) এবং খারিজ (১৯৮২) এর মাধ্যমে। খারিজ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল।
১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র আকালের সন্ধানে। কীভাবে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেটাই ছিল এই চলচ্চিত্রের সারমর্ম। আকালের সন্ধানে ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসাবে রুপোর ভালুক জয় করে। মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাপৃথিবী (১৯৯২) এবং অন্তরীন (১৯৯৪)। এখনও অবধি তার শেষ ছবি আমার ভুবন মুক্তি পায় ২০০২ সালে। মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে যার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় তিনি হলেন তপন সিংহ। তিনি সাহিত্য থেকে গল্প নিয়ে একের পর এক জনপ্রিয় ও বাণিজ্য সকল ছবি বানিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের পথ ধরেই বাঙলির সমাজ জীবনের খুঁটিনাটি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা চলচ্চিত্রের উপাদান করে তুলেছিলেন।
তাঁর প্রথম ছবি অঙ্কুশ নারায়ণ গাঙ্গুলির গল্প সৈনিক অবলম্বনে নির্মিত, কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটি হাতি ছিল। তপন সিংহের চতুর্থ ছবি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে কাবুলিওয়ালা (১৯৫৭)। তপন সিংহ রাতারাতি বাঙালি দর্শক সমাজের মন জয় করে ফেলেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল ক্ষুধিত পাষাণ (১৯৬০),ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১),ক্ষণিকের অতিথি ,সাগিনা মাহাতো (১৯৭০) ,হাটে বাজারে (১৯৬৭), গল্প হলেও সত্যি (১৯৬৬), আরোহী (১৯৬৫), অতিথি (১৯৬৫), জতুগৃহ (১৯৬৪), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৬২)বাঞ্ছারামের বাগান (১৯৮০)সবুজ দ্বীপের রাজা (১৯৭৯), সফেদ হাতি (১৯৭৭) প্রভৃতি।
বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে স্বমহিমায় তুলে ধরতে সাহায্য করেছিলেন তপন সিংহ ।তাঁর সিনেমার চরিত্রগুলোর সঙ্গে বাঙালির সামঞ্জস্য রয়েছে। তাঁর মতো সংবেদনশীল পরিশ্রমী এবং নিষ্ঠাবান বাঙালি পরিচালকের সংখ্যা খুবই কম । এসব কারণে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তপন সিংহের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রতিভার স্পর্শে বাংলা সিনেমা জগৎ উদ্ভাসিত। বাংলা সিনেমা যখন বাণিজ্যিক সফলতা পাওয়ার দৌড়ে নাম লিখেছিল সেই সময় উল্টো পথে হাঁটলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ । তিনি বাণিজ্যকে মাথায় না রেখে দর্শকদের ভালোলাগার বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করলেন । ঋতুপর্ণ ঘোষ সেই মানুষ যিনি আমজনতার কাছে বাংলা সিনেমাকে তুলে ধরলেন নতুন করে।
ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। তার পরিচালনায় প্রথম ছবি হিরের আংটি ১৯৯২ সালে মুক্তি পায়। এটি ছিল ছোটোদের ছবি।১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায়। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। এরপর দহন মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া অসুখ ছবিতে এক অভিনেত্রী ও তার আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উৎসব শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবির বিষয়বস্তু এক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি তিতলি-র গল্প এক অভিনেত্রীর মেয়েকে কেন্দ্র করে।
২০০৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন চোখের বালি। এই ছবিতেই তিনি প্রথম বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বর্যা রাইকে নিয়ে কাজ করেন।২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি ছবি রেনকোট মুক্তি পায়। ২০০৫ সালে তার বাংলা ছবি অন্তরমহল মুক্তি পায়। ২০০৭ সালে দ্য লাস্ট লিয়ার মুক্তি পায়। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তার সব চরিত্র কাল্পনিক। ২০০৯ সালে আবহমান মুক্তি পায়। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এছাড়াও নৌকাডুবি, আরেকটি প্রেমের গল্প, চিত্রাঙ্গদা তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
ঋতুপর্ণ ঘোষ একাধিক চলচ্চিত্রের জন্য একের পর এক জাতীয় পুরস্কারে তিনি তাঁর ঝুলি ভরিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের পরে ভিন্নস্বাদের সিনেমা করে যিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এবং দর্শক মনে চিরতরে নিজের আসন পেতে গেলেন তিনিই ঋতুপর্ণ ঘোষ।
বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা
এই বিষয়ে আমার দখল নেই।
একবার রিডিং দিলাম।
খুবই সুন্দর।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালীদের অবদানগুলো সম্বন্ধে জানলম।
প্রেমের ছন্দ পড়ে খুব ভালো লাগলো ধন্যবাদ
ধন্যবাদ বন্ধু
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ