সামাজিকীকরণ ( Socialisation )
সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিশুর জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ায় জীবন চলতে থাকে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি যখন এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে প্রবেশ করে তখন তাকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে, নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। এ খাপ খাওয়ানো প্রক্রিয়ার ফলে তার আচরণে পরিবর্তন আসে। নতুন নিয়মকানুন, রীতিনীতি এবং নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার প্রক্রিয়ার নাম সামাজিকীকরণ।
সামাজিকীকরণ : যে প্রক্রিয়ার সাহায্যে শিশুকে সমাজের রীতি-নীতি, আদব-কায়দা, সংস্কৃতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং শিশু তা গ্রহণ করে ও মেনে চলে তাকে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বলে।
শ্রেণিবিভাগ:
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায় । যথা- স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ ও পরিকল্পিত সামাজিকীকরণ।
স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ :
যখন শিশুর স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে সামাজিক জগতের ভাই-বোন, পিতা-মাতা, খেলার সাথি ইত্যাদির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে সমাজের রীতি-নীতি , আচার-আচরণ, অনুকরণ ও আত্তীকরণ করে তাকে স্বাভাবিক স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ বলে।
পরিকল্পিত সামাজিকীকরণ :
প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , তার বিভিন্ন পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক কর্মসূচির মাধ্যমে যে সামাজিকীকরণ ঘটে থাকেপরিকল্পিত সামাজিকীকরণ বলে।
স্বাভাবিক এবং পরিকল্পিত সামাজিকীকরণ – উভয়ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক সামাজিকীকরণ ঘটে থাকে।
সামাজিকীকরণের সংস্থা :
শিশুদের সামাজিকীকরণের জন্য কিছু সামাজিক সংস্থা আছে । যেমন-
ক) পরিবার , খ) গণমাধ্যম, গ) সমবয়সি শিশু, ঘ) বিদ্যালয়
সামাজিকীকরণের সংস্থাগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো।
ক) পরিবার :
সামাজিকীকরণের কতগুলো মাধ্যম রয়েছে। তার মধ্যে পরিবারের ভূমিকাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বংশগতি কাঁচামাল জোগায়, সংস্কৃতি নকশা জোগায় এবং পরিবারে পিতা-মাতা কারিগর হিসেবে কাজ করেন। কারণ শিশুর দৈহিক, মানসিক, পার্থিব ও অপার্থিক যাবতীয় প্রয়োজন মেটায় পরিবার। কীভাবে কথা বলতে হবে, নিজের আবেগ কীভাবে প্রকাশ করা যায়, তা শিশু পরিবার থেকে শিক্ষালাভ করে।
শিশু পরিবার থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও গ্রহণ করে, পরিবার থেকেই একটি শিশু আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
তাই বলা যায়- একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে পরিবারের তিনটি বিষয়ের উপর।
পিতা-মাতার সম্পর্ক
পিতা-মাতা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক
একই পরিবারের একাধিক শিশুদের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্ক
উল্লিখিত সম্পর্কগুলি যদি ইতিবাচক হয় তবে ঐ শিশুরা সৎ, ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে এবং সমাজে সহজ জীবনযাপন করতে পারে।
শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা পূর্ণ বিকাশও হয়ে থাকে
খ) গণমাধ্যম :
সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। গণমাধ্যমগুলো হলো সংবাদপত্র, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বেতার ইত্যাদি। তবে এগুলো সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গৌণ ভূমিকা পালন করে।
সংবাদপত্র : সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল প্রভৃতি গণমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্যগুলো সমাজের মূল্যবোধ, প্রথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচিত হয়। এছাড়া সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে এমন কিছু শিক্ষামূলক তথ্য প্রচার করা হয়, যার দ্বারা শিশু-কিশোর এমনকি যে কোনো ব্যক্তির সামাজিকীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
টেলিভিশন : দর্শন ও শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে একই সঙ্গে তথ্য সংগৃহীত হওয়ায় অন্যান্য গণমাধ্যমের তুলনায় টেলিভিশন পরিবেশিত তথ্য সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির অনুকূলে নানা ধরনের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে টেলিভিশন সামাজিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
চলচ্চিত্র : চলচ্চিত্র সামাজিকীকরণের বাহন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যদি এদেশে শুধু বিনোদনধর্মী না হয়ে আদর্শ ও বাস্তবধর্মী শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ ধরনের চলচ্চিত্র জনগণের ব্যক্তিত্বপূর্ণ মনোভাব গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
গ) সমবয়সি শিশু :
শিশুর সামাজিকীকরণে তার সঙ্গী বা খেলার সঙ্গীরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। শিশু তার সাথিদের সঙ্গে খেলাধূলা করলে তার মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি পরিস্ফুট হয়। সে স্বাবলম্বী হতে শেখে। সামাজিকীকরণে সমবয়সীদের প্রভাব ৩ বছর থেকে শুরু হলেও প্রথম বাল্যকাল থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বয়স থেকেই তাদের মধ্যে দল গঠন প্রবণতা দেখা দেয় ।দলের নিয়ম তারা অনুসরণ করে । ব্যক্তির থেকে দল তার নিকট অধিক গুরুত্ব পায় । বয়ঃসন্ধিকালে সমবয়সী দলের ভূমিকা আরো তীব্র হয়ে ওঠে । এই বয়সে তারা পরিবারের ভূমিকার বিরোধিতা করতে শুরু করে।
ঘ) বিদ্যালয় :
সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ে তিনভাবে সামাজিকীকরণ হয়-
সরকার বা পর্ষদ কর্তৃক নির্দিষ্ট পাঠক্রম:
বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটে।
সামাজিক পাঠক্রম: বিদ্যালয়ে সমবয়সি শিশুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া, সমবেতভাবে কাজ করা ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক শিখন ঘটে যা শিশুর সামাজিকীকরণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
লুক্কায়িত পাঠক্রম: লুক্কায়িত পাঠক্রম বলতে বোঝায় সেই ধরনের পাঠক্রম যা লিখিতভাবে ব্যক্ত হয় না।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
অভিনন্দন
সামাজিকীকরণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংস্থা গুলি কী কী?
samasta pdf gulo din. [email protected]