মানুষ স্বভাবতই সুন্দরের পূজারি। যে কোনো সৌন্দর্যই আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে, বিমোহিত করে, হোক তা কিছু সময়ের জন্য। প্রকৃতিতে ছড়ানো ছিটানো নানা সৌন্দর্য যেমনি আমাদের মুগ্ধ করে, আমরাও যেভাবে নিজেদের রূপ সৌন্দর্য অন্যের কাছে তুলে ধরতে প্রসাধনীর আশ্রয় নিই বিশেষ করে নারীরা নানা অলঙ্কারে তার রূপ যেভাবে প্রকাশ করে থাকেন তেমনি সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় সে সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে হলে অলঙ্কারের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়; যার মাধ্যমে একটি কবিতা অলঙ্কারের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয়ে তার শিল্পিত রূপ এবং নান্দনিকতাকে ফুটিয়ে তুলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে।
অলংকার কথাটির অর্থ হল ‘ভূষণ’ বা ‘গয়না’।নারীরা যেমন তাদের দৈহিক সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করার জন্য যে এক ধরণের ভূষণ ব্যবহার করে থাকেন, তাকে বলে দেহের অলংকার। কবিরা তেমনি কাব্য দেহের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করার জন্য যে বিশেষ ভূষণ ব্যবহার করে থাকেন, তাকে বলে কাব্যের অলংকার।
সংজ্ঞা :
সাহিত্য স্রষ্টার যে রচনা কৌশল কাব্যের শব্দধ্বনিকে শ্রুতিমধুর এবং অর্থধ্বনিকে রসাপ্লুত ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলে তাকে বলে অলংকার।
বাণী বহিরঙ্গে শব্দময়ী , অন্তরঙ্গে অর্থময়ী। তাই অলংকার দুই প্রকার– শব্দালংকার ও অর্থালংকার।
শব্দালংকার:- শব্দের বহিরঙ্গ ধ্বনির আশ্রয়ে যে কাব্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় তাকে বলে শব্দালংকার।
অর্থালংকার:- শব্দের অন্তরঙ্গ অর্থের আশ্রয়ে যে কাব্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় তাকে অর্থালংকার বলে।
শব্দালংকার ও অর্থালংকারের মধ্যে পার্থক্য :
ক) শব্দালংকারের আবেদন আমাদের কানের কাছে।
খ) শব্দালংকারে বাক্যের সংগীত ধর্মের প্রকাশ।
শব্দালংকার:
শব্দালংকারের শ্রেণিবিভাগ :
শব্দালংকার পাঁচ প্রকার। যথা –
ক) অনুপ্রাস খ) যমক গ) শ্লেষ
অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্তভাবে হোক বা বিযুক্তভাবে হোক একাধিকবার উচ্চারিত হয়ে যদি কবিতায় ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি করে তবে তাকে অনুপ্রাস অলংকার বলে ।
ক) এতে একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ একাধিক বার ব্যবহৃত হবে।
খ) একাধিক বার ব্যবহৃত ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ যুক্ত শব্দগুলো যথাসম্ভব পরপর বা কাছাকাছি বসবে।
গ) এর ফলে সৃষ্টি হবে একটি সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের।
উদাহরণ :
কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত দাদুরি ডাকিছে সঘনে
“গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘ক’ এবং ‘গ’ এই ব্যঞ্জনধ্বনিটি কবিতার মধ্যে বারংবার উচ্চারিত হওয়ার ফলে কবিতায় এমন এক ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি হয়েছে, যাতে মনে হয় পংক্তি গুলির ভেতর থেকে মেঘের ডাক ধ্বনিত হয়ে উঠছে। একই ব্যঞ্জনের পুনঃপুনঃ উচ্চারণের ফলে কবিতায় এই ধ্বনি সৌকর্য সৃষ্টি হয়েছে বলে এটি অনুপ্রাস অলংকার ।
অনুপ্রাস অলংকার ছয় প্রকার। যথা –
ক) অন্ত্যানুপ্রাস
খ) শ্রুত্যনুপ্রাস
গ) সর্বানুপ্রাস
ঘ) ছেকানুপ্রাস
ঙ) বৃত্ত্যনুপ্রাস
চ) লাটানুপ্রাস
ক) অন্ত্যানুপ্রাস:
কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃত্তির যে অনুপ্রাস অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে। পদান্তের সাথে পদান্তের বা চরণান্তের সাথে চরণান্তের যে ছন্দমিল তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে।
১. এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা।
২. দিনের আলো নিভে এলো সূর্যি ডোবে ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।
খ) শ্রুত্যনুপ্রাস :-
বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে উচ্চারিত শ্রতিগ্রাহ্য , সাদৃশ্যময় ব্যঞ্জনবর্ণের অনুপ্রাসকে শ্রুত্যনুপ্রাস অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
১. বাতাস বহে বেগে
ঝিলিক মারে মেঘে।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘বেগে’ শব্দের ‘গ’ এবং ‘মেঘে’ শব্দের ‘ঘ’ যদিও একই বর্ণ নয় তবুও এরা বাগযন্ত্রের একই স্থান (কণ্ঠ) থেকে উচ্চারিত হয়েছে বলে এটি শ্রুত্যনুপ্রাস অলংকার।
২. কালো চোখে আলো নাচে
আমার যেমন আছে।
সমগ্র চরণের সঙ্গে সমগ্র চরণের যে ধ্বনি সাম্য ঘটে তাকে সর্বানুপ্রাস অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
সন্ধ্যা মুখের সৌরভী ভাষা
বন্ধ্যা বুকের গৌরবী আশা।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে প্রথম চরণের সঙ্গে দ্বিতীয় চরণের শব্দ বা শব্দাংশ গুলির ধ্বনি সাম্য ঘটেছে বলে এটি সর্বানুপ্রাস অলংকার ।
দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দু’বার ধ্বনিত হলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস।
উদাহরণ :-
১. এখনি অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘ন’ এবং ‘ধ’ এই দুটি ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্তভাবে (ন্ধ) ক্রমানুসারে (ন, ধ) মাত্র দুবার (অন্ধ, বন্ধ) উচ্চারিত হয়েছে বলে এটি ছেকানুপ্রাস অলংকার ।
২. করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– এখানে যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ম্ব’ একের অধিকবার ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়েছে চুম্বন ও বিম্বাধরে এর মধ্যে, তাই এটি ছেকানুপ্রাস অলংকার।
আরো কিছু উদাহরণ:
৩. অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
৪. নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান (নজরুল)
৫. জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে।
একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।
উদাহরণ :-
১. সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– এখানে একক ব্যঞ্জন ‘স’ পরপর তিনবার ও ‘ল’ পরপর চারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এটি অলঙ্কার বৃত্ত্যনুপ্রাস।
২. কেতকী কত কী কথা কহে কামিনীর কানে কানে।
যে অনুপ্রাস অলংকারে একই শব্দ দুবার বা তার বেশি একই অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং ধ্বনি সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে, তখন সেই অনুপ্রাসকে লাটানুপ্রাস বলে।
উদাহরণ :-
১. গাছে গাছে ফুল ফুলে ফুলে অলি সুন্দর ধরাতল।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘গাছে’ এবং ‘ফুলে’ শব্দ দুটি দুবার একই অর্থে ব্যবহৃত হওয়ায় দুটি ক্ষেত্রেই লাটানুপ্রাস অলংকার হয়েছে ।
শ্লেষ:
একটি শব্দ একাধিক অর্থে একবার মাত্র ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম শ্লেষ। এতে একবার মাত্রই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কিন্তু তাতে ভিন্ন অর্থের ব্যঞ্জনা থাকে। এই শ্লেষ শব্দকেন্দ্রিক বলে কেউ কেউ একে শব্দ-শ্লেষ বলেন।
উদাহরণ :-
১. আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে
আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে। (মুকুন্দরাম)
– এখানে ‘গুণে’ শব্দে শ্লেষ অলংকার ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ ধনুকের ছিলায় আর অন্য অর্থ সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা গুণ।
আরও কিছু উদাহরণ:
২. মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে (নজরুল)
এখানে কবি ‘রবি’ বলতে সূর্য ও রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়েছেন।
৩. শ্রীচরণেষু
‘শ্রীচরণেষু’ একটা জুতোর দোকানের নাম। ক্রেতার ‘শ্রীচরণ ভরসা করে জুতোর দোকানদারকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হয়, তাই শ্রীচরণ শব্দের শেষে সপ্তমীর বহুচবন যুক্ত করে ‘শ্রীচরণেষু’ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শব্দটা ভাঙলে আরো গভীর তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয়- অর্থাৎ ‘শ্রীচরণে ‘ষু’(shoe বা জুতো পরার আহ্বান), যা শব্দ ভাঙায় পাওয়া গেল।
শ্রেণিবিভাগ :
শ্লেষ অলংকারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন: অভঙ্গ শ্লেষ ও সভঙ্গ শ্লেষ।
শব্দকে না ভেঙ্গে অখণ্ড অবস্থায় রেখেই যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তা-ই অভঙ্গ শ্লেষ।
উদাহরণ :-
১. আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে শ্লেষাত্মক শব্দ হল ‘গুনে’ । ‘গুনে’ শব্দের প্রথম অর্থ ধনুকের ছিলা এবং দ্বিতীয় অর্থ উৎকর্ষতা । শ্লেষাত্মক শব্দটিকে না ভেঙে একাধিক অর্থ পাওয়া যাচ্ছে বলে এটি অভঙ্গ শ্লেষ অলংকার ।
২ . মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে। শ্লেষাত্মক শব্দ ‘মধু’।একটি অর্থ honey, অন্যটি কবি মধুসূদন।
অখণ্ড অবস্থায় শব্দের শ্লেষ প্রকাশ না পেয়ে শব্দকে ভাঙলে যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তার নাম সভঙ্গ শ্লেষ। একাধিক অর্থ পাওয়ার জন্য শ্লেষাত্মক শব্দটিকে ভাঙতে হয়।
উদাহরণ :-
১. আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিলাইলে
মূলতানে গুঞ্জন তার রবে চিরদিন ।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে শ্লেষাত্মক শব্দ হল ‘মূলতান’।মূলতান কথাটির প্রথম অর্থ একটি রাগিনীর নাম।দ্বিতীয় অর্থ মূল+তান অর্থাৎ প্রধান সুর।একাধিক অর্থ পাওয়ার জন্য শ্লেষাত্মক শব্দটিকে ভাঙতে হচ্ছে বলে এটি সভঙ্গ শ্লেষ অলংকার।
২. এল না এল না সে মাধব।
মাধব=কৃষ্ণ , মাধব(মা+ধব)=স্বামী।
একই শব্দ একই স্বরধ্বনিসমেত একই ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম যমক। যমক শব্দের অর্থ হল যুগ্ম বা দুই। লক্ষনীয় যে, একই শব্দ দুই বা ততোধিক বার ব্যবহৃত হওয়া এবং ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা এর বৈশিষ্ট্য।
উদাহরণ :-
১. মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– এখানে ‘মাটি’ একটি শব্দ যা দুইবার ব্যবহৃত কিন্তু অর্থ ভিন্ন। প্রথম মাটি ধূলা অর্থে এবং দ্বিতীয় মাটি বিনষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
২. ওরে ও তরুন ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি। (নজরুল)
৩. তোমার এ বিধি, বিধি, কে পারে বুঝিতে (মধুসূদন )
সাধারণভাবে যমক চার প্রকার।যথা– ক) আদ্য যমক খ) মধ্য যমক গ) অন্ত্য যমক ঘ) সর্বযমক।
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ গুলি চরণের শুরুতে থাকে তাকে আদ্য যমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
১. ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে। (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
২. ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে।
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ গুলি চরণের মধ্যে অবস্থান করে তাকে মধ্য যমক বলে।
উদাহরণ :-
নামজাদা লেখকদেরও বই বাজারে কাটে, কাটে বেশি পোকায়। (প্রমথ চৌধুরী)
যে যমক অলংকারে চরণের শেষে যমক শব্দ গুলি থাকে তাকে অন্ত্যযমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
১. দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ
নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ। (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ গুলি চরণের সমগ্র চরণ জুড়ে থাকে তাকে সর্বযমক অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।।
সার্থক যমক ও নিরর্থক যমক অলংকার ।
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ দুটির প্রতিটিই অর্থপূর্ণ তাকে সার্থক যমক অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
১. রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে যমক শব্দ হল ‘রক্ত’ । প্রথম রক্ত শব্দের অর্থ শোণিত (blood) এবং দ্বিতীয় রক্ত শব্দের অর্থ রাগান্বিত।এখানে যমক শব্দ দুটির প্রতিটি অর্থপূর্ণ বলে এটি সার্থক যমক অলংকার।
২. মশাই দেশান্তরী করলে আমায় কেশনগরের মশায়।
৩. ঘন বন তলে এসো ঘন নীল বসনা।
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ দুটির একটি অর্থপূর্ণ ও অন্যটি অর্থহীন তাতাকে নিরর্থক যমক অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
১. শেফালি রায়ের সঙ্গে আমার
একফালিও পরিচয় নেই।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে যমক শব্দ বা শব্দাংশ হল ‘ফালি’।এখানে প্রথম ফালি শব্দের কোনো অর্থ নেই কারণ তা শেফালি শব্দের অন্তর্গত একটি শব্দাংশ মাত্র। কিন্তু দ্বিতীয় ফালি শব্দটি অর্থপূর্ণ যার অর্থ টুকরো। কাজেই যমক শব্দ দুটির একটি অর্থহীন এবং একটি অর্থপূর্ণ বলে এটি নিরর্থক যমক অলংকার ।
২. মাসীমার সীমাতেও আমি আসিনি।
৩. তারার যৌবন বন ঋতুরাজ তুমি।
৪. যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।
সোজাসুজি কোন কথা না বলে প্রশ্ন বা স্বরবিকৃতির দ্বারা বাঁকা ভাবে বলায় যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম বক্রোক্তি। বক্তা তাঁর বক্তব্যে কি কথা কি ভাবে বলতে চান তা সঠিক ভাবে জেনেও শ্রোতা অনেক সময় ইচ্ছে করে তাকে একটু বাঁকিয়ে ও ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করলে তা বক্রোক্তি অলঙ্কার হয়।
উদাহরণ:
আপনার কি পানাভ্যাস আছে?
আজ্ঞে না, পকেটের পজিশন খারাপ কিনা- তাই এখনও রপ্ত করে উঠতে পারি নাই।
– এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বক্তার জিজ্ঞাসার জবাবে শ্রোতা একটু ঘুরিয়ে বাঁকা ভাবে তার উত্তর দিয়েছেন, তাই অলঙ্কার এখানে বক্রোক্তি।
আরও কিছু উদাহরণ:
দেখি, দে-তো, এই কথাটার উত্তর দে দেখি
– তোরা দক্ষিনের লোক,উত্তরের কী জানিস?
বক্তা বুঝিয়েছে প্রশ্নের উত্তর, আর শ্রোতা বুঝেছেন উত্তর দিকের কথা।
অশ্বত্থের শাখা করে নি কি প্রতিবাদ? (জীবনানন্দ)
‘কে বলে কাব্যের ফুকে এ-পৃথিবী নিরাময় হয়, হতে পারে’ (শামসুর রাহমান)
বক্রোক্তি দুই প্রকারের। শ্লেষবক্রোক্তি ও কাকু-বক্রোক্তি। উদাহরণের প্রথমটি শ্লেষবক্রোক্তি এবং দ্বিতীয়টি কাকু-বক্রোক্তি।
একই শব্দে নানা অর্থ গ্রহণ করে উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে যে বক্রোক্তি অলংকার হয় তাকে শ্লেষ বক্রোক্তি অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
বক্তা : আপনার কপালে রাজদণ্ড আছে।
শ্রোতা : নিশ্চয়, আইন অমান্য করে ছ’মাস খেটেছি এখন সশস্ত্র বিপ্লবে না হয় বছর কত খাটবো।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে বক্তার উক্তির মধ্যে ‘রাজদণ্ড’ কথাটি শ্লেষাত্মক।যার দুটি অর্থ হলো- ক) রাজার শাসনদণ্ড হাতে পাওয়া বা রাজা হওয়া।খ) রাজশাস্তি বা গুরুতর শাশাস্তি।বক্তা এখানে প্রথম আলো অর্থ ধরে নিয়ে বক্তব্য রাখলেও শ্রোতা দ্বিতীয় অর্থটি ধরে নিয়ে উত্তর দিয়েছে।তাই এটি শ্লেষ বক্রোক্তি অলংকার ।
কাকু মানে স্বরভঙ্গি।কন্ঠধ্বনির বিশেষ ভঙ্গির ফলে বিধিমূলক বাক্য নিষেধমূলক বাক্যে কিংবা নিষেধমূলক বাক্য বিধিমূলক বাক্যে যদি পর্যবসিত হয় তবে কাকু বক্রোক্তি অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চাইহে কে বাঁচিতে চাই
卐 অর্থালংকার 卐
খ) লুপ্তোপমা :
পঞ্চ হাজার গ্রন্থ;
সোনার জলে দাগ পড়ে না,
খোলে না কেউ পাতা
আস্বাদিত মধু যেমন
যুথী অনাঘ্রাতা।
এখানে গ্রন্থ উপমেয়, উপমান মধু আর যুথী।
শুধু যখন আশ্বিনেতে
ভোরে শিউলিবনে
শিশিরভেজা হাওয়া বেয়ে
ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা
আমার মনে ভাসে ?
১। নিশাকালে যথা
মুদ্রিত কমলদলে থাকে গুপ্তভাবে
সৌরভ, এ প্রেম, বঁধু, আছিল হৃদয়ে
অন্তরিত।
ব্যাখ্যা : এখানে উপমেয় প্রেম, উপমান সৌরভ, সাধারণধর্ম অন্তরিত গুপ্তভাবে বস্তুপ্রতিবস্তু। অন্তরিত, গুপ্তভাবে ভাষায় বিভিন্ন কিন্তু অর্থে এক— গোপনে। তুলনাবাচক শব্দ ,যথা।
পাঁজর ফাটিয়া উঠে।
শঙ্খবণিকের করাত যেমতি
আসিতে যাইতে কাটে।।
ব্যাখ্যা : এই উদাহরণটিতে উপমেয় কানুর পিরীতি , উপমান শঙ্খবণিকের করাত, উপমেয়র ধর্ম বলিতে বলিতে পাঁজর ফাটিয়া উঠে এবং উপমানের ধর্ম আসিতে যাইতে কাটে। সব অবস্থাতেই দুঃখময় এই তাৎপর্যে ধর্মদুটির সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে এরা প্রতিবিম্ব ভাবের সাধারণ ধর্ম।
রূপক আলংকার :
রূপক আলংকারের শ্রেণিবিভাগ :
উদাহরণ:
যৌবন হলো উপমান, এবং বনে । যৌবনের উপর বনের অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। এখানে উপমেয় যেমন একটি উপমান ও একটি।
উদাহরণ:
উদাহরণ :
উদাহরণ : তুমি অচপল দামিনি।
অপহ্নুতি অলংকার :
যে সাদৃশ্যমূলক অলংকারে উপমেয়কে অপহ্নব বা নিষেধ করে উপমানের প্রতিষ্ঠা ঘটানো হয়, তাকে অপহ্নুতি অলংকার বলা হয়।
উদাহরণঃ-
“ও নহে গগন সুনীল সিন্ধু তারার পুঞ্জ নহেও ফেনার রাশি।”
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণটিতে ‘গগন’ ও ‘তারারপুঞ্জ’ উপমেয় এবং অপরদিকে যথাক্রমে ‘সুনীলসিন্ধু’ ও ‘ফেনার রাশি’ উপমান। এখানে ‘নহে’ যোগে উপমেয়কে নিষেধ করে উপমানের প্রতিষ্ঠা ঘটানো হয়েছে বলে এটি অপহূতি অলংকার।
উদাহরণ :
“ও কি ঝিল্পী? না, না, ঝুমুর ঝুমুর
ঘুঙুর বাজে।”
উপমেয়: ‘ঝিল্লী’। উপমান-‘ঘুঙুরের শব্দ’।
গঠনঃ মুখ নয়, চাঁদ।
ছল, ছলনা যোগেও নিষেধ করা হয়।
■ ব্যাজস্তুতি অলংকার :
যে অলংকারে কোনো উক্তির দ্বারা নিন্দার ছলে প্রশংসা বা প্রশংসার ছলে নিন্দা বোঝায় তাকে ব্যাজস্তুতি অলংকার বলে।
উদাহরণ:
“অতি বড়ো বৃদ্ধ, পতি সিদ্ধিতে নিপুন কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।”
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণটি ব্যাজস্তুতি অলংকারের।
এখানে অন্নপূর্ণা ঈশ্বরী পাটিনীকে তাঁর স্বামীর সম্পর্কে একথা বলেছেন। অন্নপূর্ণা বলেছে তাঁর স্বামী অত্যন্ত বৃদ্ধ ব্যক্তি, সিদ্ধি প্রভৃতি মাদক দ্রব্য গ্রহণ করেন, তার চরিত্রে কোনো গুণ নেই এবং তিনি একজন কপালপোড়া হতভাগ্য ব্যক্তি। আপাতভাবে এই উক্তিটি নিন্দাবাচক কিন্তু অন্নপূর্ণার এই উক্তির গূঢ় তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সে এখানে স্বামীর প্রশংসা করতে করতে চেয়েছে। অন্নপূর্ণা বলতে চেয়েছে তাঁর স্বামী অত্যন্ত প্রাজ্ঞব্যক্তি, তিনি সাফল্যের দেবতা তিনি ত্রিগুণান্বিত এবং তাঁর ললাট নেত্র থেকে অগ্নি বিচ্ছুরিত হয়। এখানে অন্নপূর্ণার উক্তির মধ্যে নিন্দার ছলে প্রশংসা বোঝানো হয়েছে বলে এটি ব্যাজস্তুতি অলংকার।
উদাহরণঃ ১ ‘কি সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে প্রচেতঃ।
(প্রচেত শব্দের অর্থ – সমুদ্র)
ব্যাজস্তুতি :
ব্যাজ মানে নিন্দা, স্তুতি মানে প্রশংসা।
উৎপ্রেক্ষা অলংকার :
যে অলংকারে উপমেয়কে প্রবল সাদৃশ্যবশতঃ উপমান বলে উৎকট সংশয় হয়, তাকে উৎপ্রেক্ষা অলংকার বলে।
উৎপ্রেক্ষা অলংকার দু’প্রকার। যথা-
ক) বাচ্য উৎপ্রেক্ষা এবং
খ) প্রতীয়মান উৎপ্রেক্ষা।
ক) বাচ্য উৎপ্রেক্ষা :
যে উৎপ্রেক্ষা অলংকারে সম্ভবনাবাচক শব্দটি স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত থাকে, তাকে বাচ্য উৎপ্রেক্ষা অলংকার বাল।
উদাহরণ :
“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।”
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণটিতে উপমেয় হল-‘পূর্ণিমার চাঁদ’। এখানে পূর্ণিমার চাঁদকে কবির মনে হয়েছে ঝলসানো রুটি, তাই ‘ঝলসানো রুটি’ হল উপমান। এখানে উপমেয়কে উপমান বলে উৎকট সংশয় হয়েছে এবং সংশয়বাচক শব্দ ‘যেন’ স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত রয়েছে বলে এটি বাচ্য উৎপ্রেক্ষা অলংকার।
উদাহরণ :
“সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল, যেন খাঁপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার।”
সংশয়বাচক শব্দ: যেন / বুঝি / মনে হয় ইত্যাদি।
প্রতীয়মান উৎপ্রেক্ষা :
সে উৎপ্রেক্ষা অলংকারে সম্ভবনামূলক শব্দটি স্পষ্টভাবে উল্লিখিত থাকে না কিন্তু অর্থের দ্বারা বা ব্যঞ্জনার দ্বারা সম্ভবনার ভাবটি প্রতীয়মান হয়, তাহলে তাকে প্রতীয়মান উৎপ্রেক্ষা অলংকার বলা হয়।
উদাহরণ:
“ওই দেখ সঞ্জয় গৌরীশিখরের উপর সূর্যাস্তের মূর্তি, কোন আনুনের পাখি মেঘের ডানা মেলে রাত্রির দিকে উড়ে চলেছে।”
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণটিতে উপমেয় হল-‘গৌরী শিখরের উপর সূর্যাস্তের মূর্তি’ এবং এই দৃশ্য দেখে কবির মনে হয়েছে ‘একটি আগুনের পাখি’ মেঘের ডানা মেলে আগত রাত্রির দিকে উড়ে চলেছে। কাজেই এটি উপমান। এখানে উপমেয়কে উপমান বলে উৎকট সংশয় হচ্ছে কিন্তু সংশয়বাচক শব্দটি স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত না থেকে অর্থের দ্বারা তা প্রতীয়মান হচ্ছে বলে এটি প্রতীয়মান উৎপ্রেক্ষা অলংকার।
উদাহরণ : ২
“এ ব্রহ্মান্ড ঝুলে প্রকান্ড রঙীন মাকাল ফল।”
উপমেয়-‘ব্রহ্মান্ড’ এবং উপমান-‘মাকাল ফল’।
উদাহরণ : ৩
‘কি পেঁখল নটবর গৌরকিশোর
অভিনব হেমকল্পতরু সঞ্চরু
সুরোধনী তীরে উজোর।”
উপমেয়: ‘নৃতরত গৌরকিশোর’
উপমান: ‘সঞ্চরু হেমকল্পতরু’
অনুপ্রাস কাকে বলে বৈশিষ্ট্য
Thank you 🤗
kanyashree prakalpa paragraphzsd
খুব উপযোগী বিতরণ।
Sir ata ke pdf a paoya jabe
শব্দালংকার এর উদাহরণ
লেখায় এতো বানান ভুল। সংশোধন চাই।
ছন্দ
Thank you🤗🤗🤗
বাহ,অসাধারন
আলংকারিক মম্মট যমক এর প্রায় নয়টি ভাগ দেখিয়েছেন
অসাধারণ ❤️অনেক ধন্যবাদ
খুব উপকার পেলাম🥀
ধন্যবাদ।
খুব উপকারী পোস্ট । ধন্যবাদ