শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ও প্রগতি মূলক শিক্ষা
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা (Child-Centric Education)
আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো শিশু। শিশুই আধুনিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। আধুনিক শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলা হয়।
যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর আগ্রহ, চাহিদা, রুচি, দক্ষতা, ক্ষমতা, মনোভাব, ইচ্ছা, প্রক্ষোভ ইত্যাদির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় তাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলে।
🔵 আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সবকিছুর কেন্দ্রে অবস্থান করে শিশু।
🔵 শিশুর রুচি আগ্রহ প্রবণতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠক্রম প্রণয়ন করা হয়ে থাকে।
🔵 শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিশু মধ্যমণি আর শিক্ষক হলেন সহায়ক।
🔵 শিক্ষার্থী শিক্ষার মূল বিন্দু যাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার অন্যান্য অঙ্গ পরিচালিত হয়।
▶️ প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় গতানুগতিক শিক্ষায় :-
🔵 শিক্ষক হলেন জ্ঞানের ভাণ্ডার আর শিক্ষার্থী শূন্যপাত্র ।
🔵শিক্ষক হলেন জ্ঞানদাতা এবং শিক্ষার্থী ছিল গ্রহীতা ।
🔵 শিক্ষার্থী এই ব্যবস্থায় নিষ্ক্রিয় । তার মানসিক ক্ষমতা, ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত।
🔵 এই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষক নির্ভর। এক্ষেত্রে জ্ঞানের উৎস হল শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক।
🔵 পুথিগত তাত্ত্বিক জ্ঞান দান করা হয়।
📘 শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য:
1. পাঠক্রম: পরিবর্তনশীল ও জীবনভিত্তিক।
2. শিক্ষণ পদ্ধতি: মনোবিজ্ঞান সম্মত ( ডাল্টন পরিকল্পনা, প্রজেক্ট পদ্ধতি, বুনিয়াদি শিক্ষা)
3. বিদ্যালয় : সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ
4. স্বাধীনতা : শিশুর আগ্রহের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
5. সৃজনধর্মীতা : সৃজনশীলতা বিকশিত করা।
6. সক্রিয়তাভিত্তিক : কাজের মাধ্যমে শিক্ষা
7. অভিজ্ঞতাভিত্তিক : শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার বিষয় নির্দিষ্ট।
8. ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ : সামগ্রিক বিকাশ
9. মানবিক সম্পর্কের উন্নয়ন : শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর পিতাসম, বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক।
10. সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব : ভালোবাসা , বন্ধুত্ব, সংঘবদ্ধতা গুণাবলির বিকাশ ঘটবে । ভবিষ্যতে আদর্শ নাগরিক গড়ে উঠবে।
▶️ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত :
রুশো (Jean-Jacques Rousseau) ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো।
1. শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জনক।
2. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ এমিল (Emile)
3. ‘এমিল’ গ্রন্থে শিশু এমিল-এর শিক্ষা কেমন হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন।
4. তাঁর মতে প্রাকৃতিক বিষয় ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার মধ্য দিয়েই হবে শিশুর প্রকৃত শিক্ষা ।
5. রুশোর মতে – “Man is born free and everywhere he is in a chains.”
6. রুশোর শিক্ষাদর্শনকে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক নিয়মে শিক্ষা’।
পেস্তালাৎসি (Johann Heinrich Pestalozzi) :
সুইস মনোবিদ
1. মনোবিজ্ঞান সম্মত শিক্ষানীতির জনক।
2. তাঁর মূল কথা হল- ইন্দ্রিয় সংযোগের দ্বারা শিক্ষা।
ফ্রয়বেল (Friedrich Frobel) : জার্মান মনোবিদ
1. কিন্ডারগার্টেন (Kindergarten) পদ্ধতির উদ্ভাবক।
2. কিন্ডারগার্টেন (Kindergarten) কথার অর্থ- শিশু উদ্যান।
3. ফ্রয়বেল শিক্ষককে মালির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
4. তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় খেলাধুলা ,সঙ্গীতচর্চা ও হাতের কাজের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
5. ফ্রয়বেলের মতো শিশুর আত্মসক্রিয়তাই একমাত্র শিক্ষণ পদ্ধতি।
6. তিনি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে উপহার(Gift) ও বৃত্তি (occupations) এর মাধ্যমে আত্মসক্রিয়তার কথা উল্লেখ করেছেন ।
মরিয়া মন্তেসরি ( Maria Montessori) : ইতালীয় চিকিৎসক এবং শিক্ষাবিদ
1. মন্তেসরি পদ্ধতির প্রবর্তক হলেন মারিয়া মন্তেসরি।
2. মারিয়া মন্তেসরি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের নাম ‘casa-dei-bambini’ বা শিশু নিকেতন ।
3. শিশুর ইন্দ্রিয় পরিমার্জন ও স্বয়ংশিক্ষার প্রবর্তন করেন ।
4. মন্তেসরির শিক্ষার মূলমন্ত্র হল শিশুর অবাধ স্বাধীনতা ।
হারবার্ট স্পেনসর(Herbert Spence) :
জার্মান শিক্ষাবিদ
1. হারবার্ট স্পেনসর আত্মবীক্ষণের সাহায্যে শিশু শিক্ষার ব্যাখ্যা করেন।
2. তাঁর এই তত্ত্ব শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পদ্ধতি নির্ণয়ে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।
মহাত্মা গান্ধী :
1. বুনিয়াদি শিক্ষাব্যবস্থা
2. কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী শ্রমের মর্যাদা,সহযোগিতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার গুণগুলি আয়ত্ত করবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :
1. শান্তিনিকেতনে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃতির সঙ্গে শিশুর নিবিড় সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
শিক্ষণ পদ্ধতি :
ডাল্টন পরিকল্পনা :
🔵 স্রষ্টা : পার্কহাস্ট
প্রোজেক্ট পদ্ধতি:
🔵 জন ডিউই সমস্যা সমাধান পদ্ধতির (Problem solving method) কথা বলেছিলেন।
🔵 তাঁর অনুগামী উইলিয়াম কিলপ্যাট্রিক
প্রজেক্ট পদ্ধতির প্রবর্তন করেন।
🔵 প্রোজেক্ট পদ্ধতির চারটি স্তরের কথা বলেছেন।
চারটি স্তর : 1. উদ্দেশ্য স্থাপন 2.পরিকল্পনা 3. সম্পাদন 4. বিচারকরণ বা পরীক্ষণ
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা
ক) শিক্ষাই জীবন (Education is life)
i) জীবনের ন্যায় প্রক্রিয়া
ii) প্রয়োজনীয় উপাদান
iii) শিশুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
খ) শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ
i) চাহিদার প্রতি গুরুত্ব
ii) ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে গুরুত্ব
iii) অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলির বিকাশ
গ) শিশু কেন্দ্রিকতার নীতিসমূহ
i)পাঠক্রম নির্ধারণ
ii) শিশুকে ভিত্তি করে পাঠক্রম
ঘ) শিখন পদ্ধতি
i)সক্রিয়তার উপর গুরুত্ব
ii) আদর্শ পদ্ধতি
iii) বিজ্ঞানভিত্তিক
ঙ) পরিচালনা
i) গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন
ii) আত্মশৃঙ্খলায় গুরুত্ব আরোপ
iii) গণতান্ত্রিকতার নীতি প্রয়োগ
প্রগতিমূলক শিক্ষা (Progressive Education)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয় যার ফলে জনগণের একটি বড়ো অংশ শিক্ষাবিমুখ হয়ে ওঠে। আর্থিক বিপর্যয়কে সামাল দিতে এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি গড়ে তুলতে 1918 সালে Progressive Education Association গঠিত হয়। সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল শিশু শিক্ষায় আগ্রহী লক্ষ লক্ষ অভিভাবক, নাগরিক এবং শিক্ষককে একত্র করে বিদ্যালয় এবং কলেজীয় শিক্ষাকে উন্নত করা । সকলে মিলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সূচনা করে, যার নাম দেওয়া হয় প্রগতিবাদী শিক্ষা।
প্রগতিবাদের সমর্থকগণ বলেন, প্রগতিবাদ প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগবাদের সঙ্গে যুক্ত।
🔵 প্রগতিবাদের জনক জন ডিউই।
🔵 শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কে চিহ্নিত করার জন্য প্রগতিমূলক কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
🔵 এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর সামাজিক উন্নতির কথা বলা হয়েছে।
🔵 বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা দান ।
🔵 শিক্ষা প্রযুক্তির ব্যবহার।
🔵 শিশুকে সম্পন্ন গতিশীল এবং সজীব প্রাণি বলে বিবেচনা করা।
🔵 বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিশুর বিকাশ পর্যালোচনা করা।
🔵 কাজের মাধ্যমে শিক্ষা , প্রোজেক্ট এবং পরীক্ষামূলক শিখনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা।
🔵 পাঠ্যপুস্তকের উপর গুরুত্ব হ্রাস।
🔵 প্রগতিবাদ প্রোজেক্ট পদ্ধতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে।