প্রত্যয়
প্রত্যয় : ‘প্রত্যয়’ সাধারণ অর্থ হল বিশ্বাস ।
‘প্রত্যয়’ শব্দটির অভিধানিক অর্থ হল প্রতীতি।
প্রত্যয়ের ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়- প্রতি-ই+অ ।
ব্যাকরণে নতুন শব্দ গঠনে শব্দটি ব্যবহৃত হয় ।
যে বর্ণ বা বর্ণ সমষ্টি ধাতু বা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে প্রত্যয় বলে ।
যেমন-
দরিদ্র+ষ্ণ্য=দারিদ্র্য
ভোর+আই=ভোরাই
কৃ+অনীয়=করণীয়
পড়্+অন্ত=পড়ন্ত
প্রত্যয়ের কাজ :
(ক) প্রত্যয় নতুন শব্দ গঠন করে । যথা-চল্+শানচ্=চলমান ।
(খ) প্রত্যয় পদান্তর করতে সাহায্য করে । যথা- মহত+ত্ব=মহত্ত্ব ।
(গ) প্রত্যয় শব্দের প্রতিরূপ জানতে সাহায্য করে । যথা-বৃধ+শানচ্=বর্ধমান ।
(ঘ) প্রত্যয় শব্দের একপদী করণ করতে সাহায্য করে । যথা- বেদ জানেন যিনি = বৈদান্তিক প্রভৃতি ।
ইৎ : ধাতু বা শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করলে দেখা যাবে প্রত্যয়ের কিছু অংশ নবগঠিত ধাতু বা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং বাকি অংশটুকু লোপ পায়। প্রত্যয়ে এই লোপ পাওয়া অংশটিকেই ইৎ বলে।
যেমন – গম্ + অনট্ = গমন। এখানে ট্ লোপ পেয়েছে। অর্থাৎ এখানে ট্ – এর ইৎ হয়েছে।
আগম : মূল ধাতু ও প্রত্যয়ে স্বরটি নেই অথচ নবগঠিত শব্দে নতুন স্বরটি আছে –এমন হলে স্বরের আগম হয়।
যেমন – ক. √লিখ্ + ক্ত = লিখত হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয়েছে লিখিত। খ্ – এর পর ই স্বরের আগম হয়েছে এবং লিখত শব্দ লিখিত হয়েছে।
উপধা : ধাতু বা শব্দের অন্তবর্ণের পূর্ব বর্ণকে উপধা বলে।
যেমন – লক্ষ্মী শব্দের অন্ত্যবর্ণ ঈ এর পূর্ববর্ণ ম্।এখানে ম্ হল উপধা।
প্রকৃতি : মৌলিক ভাব প্রদান করে এমন অবিভাজ্য পদ বা পদের অংশই হচ্ছে প্রকৃতি।
প্রকৃতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা —
ক. নাম প্রকৃতি : যে প্রকৃতি কোনো প্রত্যয় বা বিভক্তি ছাড়াই নিজেই পদরূপে অবতীর্ণ হতে পারে তাকে নাম প্রকৃতি বলে।
যেমন – মা , জল , ফল ইত্যাদি।
খ. ধাতু প্রকৃতি : যে প্রকৃতির মাধ্যমে পদের একটি অবশিষ্ট মৌলিক অংশ পাওয়া যায় , যার মাধ্যমে কোনো ক্রিয়া জাতীয় ভূমিকাকে নির্দেশ করা হয় , তাকে ধাতু প্রকৃতি বলে।
যেমন – খা , চল্ , গম্ , দৃশ্ ইত্যাদি।
প্রাতিপদিক : বিভক্তিহীন নামশব্দকে প্রাতিপদিক বলে।
★★ স্বরের পরিবর্তন ★★
■ ১. গুণ : ধাতুর ই , ঈ স্থানে এ-কার (বা অয়), উ , ঊ স্থানে ও -কার (বা অব) এবং ঋ স্থান অর্ হবে। এই ভাবে ধাতুর স্বরের পরিবর্তনকেই গুণ বলে।
যেমন -√লিখ্ >লেখন
√দিশ্ >দেশ
√নী > নয়ন
■ ২. বৃদ্ধি : ধাতু ও শব্দের অ, আ স্থানে আ- কার , ই , ঈ ,উ , এ স্থানে ঐ – কার(বা আয়্) , উ , ঊ , ও স্থানে ঔ – কার (বা আব্) এবং ঋ স্থানে আর্ হবে। এইভাবে স্বরের পরিবর্তনকে বৃদ্ধি বলে।
যেমন – অদিতি + ষ্ণ্য =আদিত্য
দিন + ইক =দৈনিক
ভূত + ষ্ণিক = ভৌতিক
■ ৩. সম্প্রসারণ : ধাতুর অন্তঃস্থ “য” বর্ণ ই-কার হলে , “র” বর্ণ ঋ -কার হলে এবং অন্তঃস্থ “ব” বর্ণ “উ” বর্ণে পরিবর্তিত হলে সম্প্রসারণ হয়।
যেমন – ব>উ √বচ্ +ক্তি = উক্তি
য>ই √যজ্ +ক্তি =ইতি
√যজ্ > ইষ্টি (য হয়েছে ই)
■ ৪. অপশ্রুতি : পূর্বে আলোচিত ধাতু ও শব্দের স্বর পরিবর্তনের তিনটি নিয়মকে একত্রে অপশ্রুতি বলা হয়। অর্থাৎ ধাতু থেকে শব্দ গঠনে বা শব্দ থেকে অন্য শব্দ গঠনে স্বর পরিবর্তনের তিনটি ধারা — গুণ , বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণকে একত্রে অপশ্রুতি বলে।
প্রত্যয়ের শ্রেণিবিভাগ :
প্রত্যয় প্রধানত তিনপ্রকার। যথা – কৃৎ, তদ্ধিত ও ধাত্ববয়ব প্রত্যয় ।
(ক) কৃৎ প্রত্যয় :
ধাতুর সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে কৃৎ প্রত্যয় বা ধাতু প্রত্যয় বলে ।
যথা- গম্+তব্য=গন্তব্য ; চল্+আ=চলা । ধাতুর উত্তরে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে নতুন শব্দটি গঠন করে, তাকে কৃদন্ত শব্দ বা কৃৎ প্রত্যয়ান্ত শব্দ বলে । যথা- গন্তব্য, চলা প্রভৃতি ।
(খ) তদ্ধিত প্রত্যয় :
শব্দের সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে শব্দ প্রত্যয় বা তদ্ধিত প্রত্যয় বলে ।
যথা- ভূগোল+ষ্ণিক = ভৌগোলিক ; সোনা+আলি=সোনালি ।
শব্দের উত্তরে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে নতুন শব্দটই গঠন করে, তাকে তদ্ধিতান্ত শব্দ বলে । যথা – ভৌগোলিক , সোনালি ।
(গ) ধাত্ববয়ব প্রত্যয় :
ধাতু বা নাম শব্দের উত্তর যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন ধাতু সৃষ্টি করে। তাকে ধাত্ববয়ব প্রত্যয় বলে । কর্(ধাতু)+আ(ধাত্ববয়ব প্রত্যয়)=করা (ধাতু করানো অর্থে) ; জ্ঞা(ধাতু)+সন(ধাত্ববয়ব প্রত্যয়)=জিজ্ঞাস্(ধাতু) ।
কৃৎ প্রত্যয় ও তদ্ধিত প্রত্যয়ের পার্থক্য :
(ক) কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয় ধাতুর উত্তর , তদ্ধিত প্রত্যয় যুক্ত হয় শব্দের উত্তর ।
(খ) কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত শব্দকে বলা হয় কৃদন্ত শব্দ, তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে গঠিত শব্দকে বলা হয় তদ্ধিতান্ত শব্দ ।
(গ) ধাতুর উত্তর এককালে একটিমাত্র কৃৎপ্রত্যয় যুক্ত হয়, কিন্তু শব্দের উত্তর তদ্ধিত প্রত্যয় এককালে একের বেশি যুক্ত হতে পারে ।
যেমন- কৃ+তব্য=কর্তব্য – এখানে কর্তব্য শব্দের আর কোনো কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হতে পারে না ; কিন্তু লোক+ষ্ণিক=লৌকিক – এই ‘লৌকিক’ শব্দের পড়ে তদ্ধিত ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে লৌকিকতা হতে পারে ।
(ঘ) কৃৎ প্রত্যয়ের পকৃতি অর্থহীন হবে । যেমন-গম্, চল্ ; তদ্ধিত প্রত্যয়ের প্রকৃতি অর্থবোধক হবে । যেমন-ঢাকা, সোনা ইত্যাদি ।
কৃৎ প্রত্যয় ও ধাত্ববয়ব প্রত্যয়ের পার্থক্য :
(ক) কৃৎ প্রত্যয় ধাতুর উত্তরযুক্ত হয় ; ধাত্ববয়ব ধাতু ও নাম সব্দের উত্তর যুক্ত হয় ।
(খ) কৃৎ প্রত্যয় যোগে নতুন শব্দ সৃষ্টি হয় ; আর ধাত্ববয়ব যোগে নতুন ধাতু সৃষ্টি হয় ।
উপসর্গ : যে সকল অব্যয়ে কোনো প্রত্যয় যুক্ত হয় না , যারা ধাতুর পূর্বে বসে ধাতুর অর্থের পরিবর্তন ঘটায় , তাদের উপসর্গ বলে।
যেমন – √জি + অচ্ = জয়
ক. অজয় :অ – √জি+ অচ্
খ. বিজয় :বি – √জি+ অচ্
গ. সুজয় :সু – √জি+ অচ্
ঘ. সঞ্জয় :সম্ – √জি+ অচ্
— এখানে লক্ষণীয় চারটি উদাহরণে √জি ধাতুর পূর্বে অ , বি , সু , সম্ উপসর্গ যুক্ত হয়ে নবগঠিত শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
উপপদ : যে সকল পদের পরস্থিত ধাতুর উত্তর বিশেষ বিশেষ কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয় , সেই সব পদকে উপপদ বলে। আক্ষরিক অর্থে উপপদ হল – সমীপবর্তী পদ।
যেমন – ইন্দ্রজিৎ = ইন্দ্র- √জি+ ক্বিপ এখানে ‘ইন্দ্র’ হল উপপদ।
কৃৎ প্রত্যয় :
কৃৎ প্রত্যয় দু’প্রকার।যথা –
(ক) সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয়
(খ) বাংলা কৃৎ প্রত্যয়
(ক) সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয় :
(১) তব্য : উচিত বা যোগ্য অর্থে এই প্রত্যয় হয় ।
যেমন-
কৃ+তব্য=কর্তব্য, জ্ঞা +তব্য = জ্ঞাতব্য,
ধৃ+তব্য=ধর্তব্য, দা+তব্য=দাতব্য,
গম্+তব্য=গন্তব্য, দৃশ+তব্য=দ্রষ্টব্য,
বচ্+তব্য=বক্তব্য, মন্+তব্য=মন্তব্য,
স্মৃ+তব্য=স্মর্তব্য, ভূ+তব্য=ভবিতব্য,
কহ্+তব্য=কহতব্য ইত্যাদি ।
(২) অনীয় : উচিত বা যোগ্য অর্থে ‘অনীয়’ প্রত্যয় হয় ।
যেমন-কৃ+অনীয়=করণীয়,স্মৃ+অনীয়=স্মরণীয়,
দৃশ্+অনীয়=দর্শনীয়,পা+অনীয়=পানীয়,
স্পৃহ্+অনীয়=স্পৃহনীয়,গম্+অনীয়=গমনীয়,
হৃ+অনীয়=হরণীয়, রক্ষ্ +অনীয় =রক্ষণীয়,
মান্ +অনীয় =মাননীয়, বন্দ্ +অনীয় =বন্দনীয়,
শিক্ষ্ +অনীয় =শিক্ষণীয়, শুচ্ +অনীয় =শোচনীয়,
শ্রু +অনীয় = শ্রবণীয়
(৩) য(যৎ, ন্যৎ) : উচিত বা যোগ্য অর্থে যৎ>’য’ প্রত্যয়ও হয় । যেমন-দা+যত=দেয়, গম্+যত=গম্য, রম্+যত=রম্য, লভ্+যত=লভ্য, সহ্+যত=সহ্য ইত্যাদি ।
ঋ-কারান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত ধাতুর পরে উচিতার্থে ন্যৎ>’য’ প্রত্যয় হয় । যেমন- কৃ+ন্যৎ=কার্য, ধৃ+ন্যৎ=ধার্য, বচ্+ন্যৎ=বাক্য ইত্যাদি ।
কোনো শব্দ একই সঙ্গে যৎ বা ন্যৎ এবং অনীয় প্রত্যয় হয় না । যেমন- পূজা বা পূজনীয়(পূজ্যণীয় নয়) ; লক্ষ্য বা লক্ষণীয়(লক্ষ্যণীয় নয়) ; অচিন্ত্য বা অচিন্তনীয়(অচিন্ত্যণীয় নয়) ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : প্র-যুজ্+জ=প্রযোজ্য; পরি-হৃ+য=পরিহার্য ; বি-চার্+য=বিচার্য ; বি-বিচ্+য=বিবেচ্য ; পরি-ধা+যৎ=পরিধেয় ।
(৪) মান, আন(শানচ্) : কোনো কাজ চলছে এরূপ বোঝাতে কোথাও ‘মান’ কোথাও ‘আন’ (মূল সংস্কৃত প্রত্যয় ‘শানচ্’) হয় ।
যেমন – বৃধ্+(শানচ্)মান=বর্ধমান ;
বৃৎ+(শানচ্)মান=বর্তমান ;
বিদ্+মান=বিদ্যমান ;
ভাস্+মানা=ভাসমান ;
মৃ+মান=ম্রিয়মান ;
শী+মান=শয়ান ;
চল্+মান=চলমান ;
আস্+মান=আসমান ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় :
বি-বদ্+শানচ্=বিবদমান ;
বি-লী+শানচ্=বিলীয়মান ;
বি-রাজ + শানচ্ = বিরাজমান ;
প্র-বহ্+শানচ্= প্রবহমান প্রভৃতি ।
(৫) তা(তৃচ্) : ধাতুর উত্তর এই প্রয়োগযোগে বিশেষ্যপদ গঠন করা হয় । যেমন- দা+(তৃচ্)তা =দাতা ; বচ্+তা=বক্তা ; শ্রু+তা=শ্রোতা ; পা+তা=পিতা ; নী+তা=নেতা ; জ্ঞা+তা=জ্ঞাতা ; গ্রহ্+তা=গ্রহীতা ; দৃশ্+তা=দ্রষ্টা ; সৃজ+তা=স্রষ্টা ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : বি-জি+তৃচ্=বিজেতা ; বি-ধা+তৃচ্=বিধাতা ; অভি-নী+তৃচ্=অভিনেতা ।
(৬) তি(ক্তি) : ধাতুর পরে এই প্রত্যয় যোগে ভাববাচক বিশেষ্য পদ গঠিত হয় । যেমন – গম্+(ক্তি)তি=গতি ; স্মৃ+তি=স্মৃতি ; ভী+ক্তি=ভীতি ; খ্যাতি=খ্যা+ক্তি ; শাস্+ক্তি=শাস্তি ; শ্রু+ক্তি=শ্রুতি ; তৃপ+ক্তি=তৃপ্তি ; দৃশ্+ক্তি=দৃষ্টি ; সৃজ+ক্তি=সৃষ্টি ; মুচ্+ক্তি=মুক্তি ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : প্র-গম্+ক্তি=প্রগতি ; বি-জ্ঞপ+ক্তি=বিজ্ঞপ্তি ; প্রতি-পদ+ক্তি=প্রতিপত্তি ; সম্-পদ +ক্তি=সম্পত্তি ; সম্-কৃ+তি=সংস্কৃতি । প্রয়োগ : অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ ।
(৭) ত(ক্ত) : অতীতকালে কার্য সম্পন্ন হয়েছে বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন – গম্+ক্ত=গত ; ভী+ক্ত=ভীত ; দৃশ্+ক্ত=দৃষ্ট ; সৃজ্+ক্ত=সৃষ্ট ; ভজ্+ক্ত=ভক্ত ; ভুজ্+ক্ত=ভুক্ত ; লভ্+ক্ত=লব্ধ ; লুভ্+ক্ত=লুব্ধ ; জ্ঞা + ক্ত = জ্ঞাত
প্রী + ক্ত = প্রীত, চ্যু + ক্ত = চ্যুত, শ্রু + ক্ত = শ্রুত, খ্যা + ক্ত = খ্যাত, হৃ + ক্ত =হৃত
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : প্র-গম্+ক্ত=প্রগত ; পরা-গম্+ক্ত=পরাগত ; বি-গম্+ক্ত=বিগত ; সম্-কৃ+ক্ত= সংস্কৃত ; প্রভৃতি ।
(৮) ইষ্ণু: স্বভাব বা ধর্ম অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয় যুক্ত শব্দ বিশ্লেষণ হয় । যেমন – বৃধ+ইষ্ণু=বর্ধিষ্ণু ; সহ্+ইষ্ণু=সহিষ্ণু ; চল্+ইষ্ণু=চলিষ্ণু ; ক্ষি+ইষ্ণু=ক্ষয়িষ্ণু । প্রয়োগ : যদি তুমি চলিষ্ণু এবং সহিষ্ণু হও, তবে বর্ধিষ্ণু থাকবে, না হলে ক্ষয়িষ্ণু হতে হবে ।
(৯) অন(অনট্) : ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য পদ গঠনে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- গম্+অনট্=গমন ; নী+অনট্=নয়ন ; দৃশ্+অনট্=দর্শন ; শ্রু+অনট্=শ্রবণ ; গর্জ+অনট্=গর্জন ; পা+অনট=পান ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : আ-নী+অনট্=আনয়ন ; অধি-ই+অনট্=অধ্যয়ন ; প্র-দৃশ্+অনট্=প্রদর্শন ।
(১০) অক্(ণক্) : এই প্রত্যয় যোগে সাধারণত বিশেষ্যপদ গঠিত হয় । যেমন – পচ্+অক্ = পাচক ; পঠ্+অক্=পাঠক ; দৃশ্+অক্=দর্শক ; গৈ+অক্=গায়ক ; দা+অক্=দায়ক ; হন্+অক্=ঘাতক ; ধৃ+অক্=ধারক । শস্+অক্=শাসক ; কৃষ্+অক্+কৃষক ; সেব্+অক্=সেবক ; ভিদ্+অক্=ভেদক ; ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : বি-ধা+অক্=বিধায়ক ; প্র-দৃশ্+অক্=প্রদর্শক ।
(১১) সন্ : ‘ইচ্ছা’ অর্থে সন্ প্রত্যয় যুক্ত হয় । তবে ‘সন্’ ‘ইৎ’ হয়ে তারপর ‘অ’ এবং ‘আ’ প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য পদ হয় । যেমন- পা+সন্+অ+আ=পিপাসা ; জ্ঞা+সন্+অ+আ=জিজ্ঞাসা ; মুচ্+সন্+অ+আ=মুমুক্ষা ; জি+সন্+অ+আ=জিগীষা ; শ্রু+সন্+অ+আ=শ্রুশ্রূষা ; হন্+সন্+অ+আ=জিঘাংসা ;
মান্+সন্+অ+আ = মীমাংসা
লভ্+সন্+অ+আ=লিপ্সা ; ভুজ্+সন্+অ+আ=বুভুক্ষা ;
মুচ্ +সন্+অ+আ = মুমুক্ষা
কৃ+সন্+অ+আ=চিকীর্ষা ;
জীব্+সন্+অ+আ =জিজীবিষা
গুপ্+সন্+অ+আ = জুগুপ্সা
জ্ঞা+সন্+উ=জিজ্ঞাসু ; পিপাসু=পা+সন্+উ ;
ভুজ্+সন্+উ=বুভুক্ষু ;
মুচ্+সন্+উ=মুমুক্ষু ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : অনু-কৃৎ+সন্+অ+আ=অনুচিকীর্ষা ; উপ-কৃ+সন্+অ+আ=উপচিকীর্ষা প্রভৃতি ।
(১২) ‘ইন্’ : এই প্রত্যয় যোগে পুংলিঙ্গে প্রথমবার একবচনে ‘ঈ’ হয় । যেমন – জি+ইন্=জয়ী ; ভুজ্+ইন্=ভোগী ; ত্যজ্+ইন=ত্যাগী ; মন্ত্র+ইন্=মন্ত্রী ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : অনু-গম্+ইন্=অনুগামী ; প্রতি-বদ্+ইন্=প্রতিবাদী । প্রয়োগ : এখন ত্যাগী মানুষের চেয়ে ভোগী মানুষের সংখ্যাই বেশি ।
(১৩) অ(ঘঞ্) : ধাতুর উত্তর এই প্রত্যয়যোগে প্রধানতঃ ভাববাচক বিশেষ্য পদ গঠিত হয় । যেমন – পচ+(ঘঞ্)অ=পাক ; শচ্+ঘঞ্=শোক, ভুজ্+ঘঞ্=ভোগ ; ত্যজ+ঘঞ্=ত্যাগ ; ভজ্+ঘঞ=ভাগ ; যুজ্+ঘঞ্=যোগ্য ; লভ্+ঘঞ্=লাভ ; পঠ্+ঘঞ=পাঠ ; বস্+ঘঞ্=বাস ইত্যাদি ।
উপসর্গ যোগে প্রত্যয় : প্র-বস্+ঘঞ্=প্রবাস ; সম্+যুজ্+ঘঞ্=সংযোগ । প্রয়োগ : প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যদি খসে ।
(১৪) শতৃ : শতৃ প্রত্যয় যুক্ত হলে শব্দের উচ্চারণ হবে ‘অৎ’ । বাংলায় শতৃ প্রত্যয়ান্ত শব্দ কম ব্যবহৃত । যেমন-জীব্+শতৃ=জীবৎ ; মহ্+শতৃ=মহৎ ; জাগৃ+শতৃ=জাগ্রৎ ; চল্+শতৃ=চলৎ ।
(১৫) ন্যৎ, যৎ, ক্যপ্ : উচিত বা যোগ্য অর্থে এই তিনটি প্রত্যয় ব্যবহৃত হয় । বাকি অংশগুলি ইৎ হয় তিনটি প্রত্যয়েরই কেবল ‘য’ অংশটুকু যুক্ত হয় । বাংলায় এই তিনটি প্রত্যয়কেই ‘য’ রূপে ধরা হয় । যেমন- কৃ+ন্যৎ=কার্য ; পা+যত=পেয় ; পচ্+ন্যত=পাচ্য ; পঠ্+ন্যৎ=পাঠ্য ; সহ্+ন্যৎ=সহ্য ; ভুজ্+ন্যত=ভুজ্য ; লভ্+যৎ=লভ্য ; শাস্+ক্যপ্=শিষ্য ; বিদ্+ক্যপ্+আ=বিদ্যা ; ভৃ+ক্যপ্=ভৃত্য ; হন্+ক্যপ্+আ=হত্যা ; পরি-ধা+যত=পরিধেয় ।
(১৬) ক্বিপ্ : ক্বিপ্ প্রত্যয় ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হলে পুরোটাই ইৎ বা লুপ্ত হয় । তাই একে শূণ্য প্রত্যয় বলা হয় । যেমন- উদ্+ভিদ্+ক্বিপ্=উদ্ভিদ ; আ-শাস্+ক্বিপ্=আশিস্ ; বি-দ্যু+ক্বিপ্=বিদ্যুৎ ।
(খ) বাংলা কৃৎ প্রত্যয় :
(১) অ : ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য তৈরিতে ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ অ প্রত্যয় যুক্ত হয় । যেমন- চল্+অ =চল, দুল্+অ = দুল, ঝুল্+অ=ঝুল, কাট্+অ=কাট ; কট্মট্+অ=কটমট(কটমট ভাষা,কটমট দৃষ্টি) ; ছাঁট্+অ=ছাঁট ; কাঁদ্+অ=কাঁদ ; পড়্+অ ।
(২) আ : এই প্রত্যয়যোগে বাংলা প্রযোজক ধাতু তৈরি হয় । যেমন-
চল্+আ =চলা, খা +আ=খাওয়া, পা+আ= পাওয়া, রাঁধ্+আ = রাঁধা
কর্+আ=করা, পড়্+আ
(৩) আই : ভাববাচক বিশেষ্য বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- ঝাড়্+আই=ঝাড়াই ; বাছ্+আই= বাছাই ; যাচ্+আই=যাচাই ; খোদ্+আই=খোদাই ; লড়্+আই=লড়াই ইত্যাদি ।
(৪) আও : এই প্রত্যয়যোগে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যপদ গঠিত হয় । যেমন- বাঁচ্+আও =বাঁচাও, ঘির্+আও=ঘেরাও ; ফল্+আও=ফলাও ; ঢাল্+আও=ঢালাও ; চড়্+আও=চড়াও ; লগ্+আও=লাগাও ; পাকড়্+আও=পাকড়াও ।
(৫) অন : এই প্রত্যয় যোগে খাঁটিবাচক ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য পদ গঠিত হয় । যেমন- নাচ্+অন্= নাচন ; মাত্+অন=মাতন , কাঁদ্+অন=কাঁদন ; ঝাড়্+অন=ঝাড়ন ; বাঁচ+অন=বাঁচন ; মার্+অন=মারন ; ধর্+অন= ধরন ; চল্+অ=চলন ; বল্+অন=বলন ; ঝুল্+অন=ঝুলন ।
(৬) অন্ত : কর্তৃবাচ্যে ধাতুর উত্তর বর্তমান কালে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- পড়্+অন্ত=পড়ন্ত ; বাড়্+অন্ত=বাড়ন্ত ; উড়্+অন্ত=উড়ন্ত ; চল্+অন্ত=চলন্ত ; ডুব্+অন্ত=ডুবন্ত ; ফল্+অন্ত=ফলন্ত ; ফুট্+অন্ত=ফুটন্ত ; ঝুল্+অন্ত =ঝুলন্ত ইত্যাদি ।
(৭) ‘তি’ : এই প্রত্যয়যোগে কখনও বিশেষ্য কখনও বিশেষণ পদ গঠিত হয় । যেমন – বস্+তি=বসতি ; কাট্+তি=কাটতি ; বাড়্+তি=বাড়তি ; ঝড়্+তি=ঝড়তি ; পড়্+তি=পড়তি ; উঠ্+তি=উঠতি ; চল্+তি =চলতি ; ফির্+তি=ফিরতি ।
(৮) আরি, উরি(রি) : এই প্রত্যয়যোগে বিশেষ্য গঠিত হয় । যেমন – ডুব্+আরি=ডুবারি ; ডুব্+উরি=ডুবুরি ; ধুন্+আরি=ধুনারি ; ধুন্+উরি=ধুনুরি ; ভিখ্+আরি=ভিখারি ; কাট্+আরি=কাটারি ; ইত্যাদি ।
(৯) আনি, উনি : এই প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য গঠিত হয় । যেমন – নিড়া=আনি=নিড়ানি ; শুন্+আনি=শুনানি ; ছাঁক+উনি=ছাঁকুনি ; রাঁধ্+উনি=রাঁধুনি ।
(১০) ইয়ে(ইয়া) : এই প্রত্যয়যোগে বিশেষ্য গঠিত হয় । যেমন – খা+ইয়া(ইয়ে)=খাইয়া>খাইয়ে ; গা+ইয়ে=গাইয়ে ; বাজ্+ইয়ে=বাজিয়ে ; খেল্+ইয়ে=খেলিয়ে ; বল্+ইয়ে=বলিয়ে ; কহ্+ইয়ে=কইয়ে ইত্যাদি ।
(১১) উক্ : এই প্রত্যয় টি স্বভাব নির্দেশ করে । যেমন- মিশ্+উক্=মিশুক ; নিন্দ্+উক= নিন্দুক, খা+উক্=খাউক ; ভাব্+উক্=ভাবুক ইত্যাদি ।
(১২) উয়া(ত্ত) : এই প্রত্যয় টি স্বভাব নির্দেশ করে । যেমন – পড়্+উয়া=পড়ুয়া>পড়ো ; উড়ু+উয়া=উড়ুয়া>উড়ো ; ভুল্+উয়া=ভুলুয়া>ভুলো ; লাগ্+উয়া=লাগুয়া>লাগোয়া ।
(১৩) না : এই প্রত্যয়যোগে ক্রিয়াবাচক ও বস্তুবাচক বিশেষ্য হয় । যেমন-কাঁদ্+না=কান্না ; রাঁধ্+না=রান্না ; ঢাক্+না=ঢাকনা ; বাট্+না=বাটনা ; ঝর্+না=ঝরনা ; বাজ্+না=বাজনা ইত্যাদি ।
(১৪) অনা-প্রত্যয় : খেল্+অনা=খেলনা ; ঝর্+অনা=ঝরনা ।
(১৫) আনো-প্রত্যয় : দেখা+আনো=দেখানো ; পড়া+আনো=পড়ানো ; বেতা+আনো=বেতানো ; ভুলা+আনো=ভোলানো ; শোনা+আনো=শোনানো ।
(১৬) ই-প্রত্যয় : হাস্+ই=হাসি ; ছুট্+ই=ছুটি ; ঝুল্+ই=ঝুলি ; ডুব্+ই=ডুবি ; ঝাঁপ+ই=ঝাঁপি ; ফির্+ই=ফিরি(ফেরি) প্রভৃতি ।
তদ্ধিত প্রত্যয় :
তদ্ধিত প্রত্যয় দু’প্রকার। যথা –
সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় ও বাংলা সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয়
(ক) সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় :
(১) ষ্ণ>অ : অপত্য (সন্তান) অর্থে ও ভাবার্থে শব্দের পরে ‘ষ্ণ’ প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ের শব্দগুলো কখনো বিশেষ্য কখনো বা বিশেষণ হয় । যেমন – রঘু+ষ্ণ=রাঘব ; মনু+অ=মানব ; কুরু+অ=কৌরব ; পান্ডু+অ=পান্ডব ; বিষ্ণু+ষ্ণ= বৈষ্ণব ; পুত্র+অ=পৌত্র ; দুহিতা+অ=দৌহিত্র ; কশ্যপ+অ=কাশ্যপ ; ভরত+অ=ভারত ইত্যাদি (বিশেষ্য), নিশি+অ=নৈশ ; বিধি+অ=বৈধ ; শিব+অ=শৈব ; ঋষি+অ=আর্য ইত্যাদি (বিশেষণ) । ভাবার্থে : শিশু+অ=শৈশব ; বন্ধু+অ=বান্ধব ইত্যাদি ।
(২) ষ্ণ্য>য : অপত্যার্থে ও ভাবার্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও বিশেষ্য হয় । যেমন- অপত্যার্থে : চণক+ষ্ণ্য=চাণক্য ; দিতি+ষ্ণ্য=দৈত্য ; অদিতি+ষ্ণ্য=আদিত্য ভাবার্থে : সুজন+ষ্ণ্য=সৌজন্য ; ত্রিলোক+ষ্ণ্য=ত্রৈলোক্য ; বিপরীত+ষ্ণ্য=বৈপরীত্য ; সম+ষ্ণ্য=সাম্য ; দূত+ষ্ণ্য=দৌত্য, দীন+ষ্ণ্য=দৈন্য ; প্রমান+ষ্ণ্য=প্রামান্য ; সহায়+ষ্ণ্য=সাহায্য ; বিগদ্ধ+ষ্ণ্য=বৈগদ্ধ্য স্বতন্ত্র+ষ্ণ্য=স্বাতন্ত্র্য ; অভিজাত+ষ্ণ্য=আভিজাত্য ; পুরোহিত+ষ্ণ্য=পৌরহিত্য ; স্থাপিত+ষ্ণ্য=স্থাপত্য ; কবি+ষ্ণ্য=কাব্য ; সহিত+ষ্ণ্য=সাহিত্য ; অলস+ষ্ণ্য=আলস্য ; অনুকূল+ষ্ণ্য=আনুকূল্য ; লবণ+ষ্ণ্য=লাবণ্য ইতাদি ।
ষ্ণ্য>য প্রত্যয় যোগে সাধারণত : বিশেষ্য হলেও কখনো কখনো ভাবার্থে বিশেষণও হয় । যেমন-
গ্রাম+ষ্ণ্য>য=গ্রাম্য ; পাচ্+য=প্রাচ্য ; প্রত্যচ্+য=প্রতীচ্য ; উদচ্+য=উদীচ্য ; দক্ষিণ/দক্ষিণা+ষ্ণ্য> দাক্ষিণ্য (বি) ।
‘ষ্ণ’ প্রত্যয় যুক্ত হলে শব্দের শেষে কোনো য-ফলা হয় না ; কিন্তু ‘ষ্ণ্য’ প্রত্যয় যুক্ত হলে শব্দের শেষে য-ফলা হয়।
(৩) ষ্ণি>ই : অপত্যার্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও বিশেষ্য । যেমন-
দশরথ+ষ্ণি=দাশরথি ; সুমিত্রা+ষ্ণি=সৌমিত্রি ; রাবন+ষ্ণি=রাবণি ইত্যাদি । ভগীরথ+ষ্ণ=ভাগীরথ >ভাগীরথী (স্ত্রী লিঙ্গে ঈ) ।
(৪) ষ্ণেয়>এয় : অপত্যার্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও বিশেষ্য । যেমন-
বিমাতৃ+ষ্ণেয়=বৈমাত্রেয় ; কুন্তী+ষ্ণেয়=কৌন্তেয় ; ভগিনী+ষ্ণেয়=ভাগিনেয় ; রাধা+ষ্ণেয়=রাধেয় ; গঙ্গা+ষ্ণেয়=গাঙ্গেয় ; ইত্যাদি । ভাবার্থে : পথ+ষ্ণেয়=পাথেয় ; শ্রদ্ধা+ষ্ণেয়=শ্রদ্ধেয় । শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি কে শ্রদ্ধা কর ।
(৫) ষ্ণায়ন>আয়ন : অপত্য ও জাত অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও বিশেষ্য ।
যেমন- নর+ষ্ণায়ন=নারায়ণ ; দ্বীপ+ষ্ণায়ন=দ্বৈপায়ন (দ্বীপ জাত) ; দক্ষ+ষ্ণায়ন=দাক্ষায়ণ ; বৎস+ষ্ণায়ন=বাৎসায়ন ; কাত্য+ষ্ণায়ন=কাত্যায়ন ইত্যাদি । রাম+আয়ন=রামায়ণ>রামকে অয়ন(আশ্রয়) করে রচিত গ্রন্থ=বহুব্রীহি । রস+আয়ন=রসায়ন ; উত্তর+আয়ন=উত্তরায়ণ ; দক্ষিণ+আয়ন=দক্ষিণায়ন ।
(৬) ষ্ণীয়>ঈয় : জাত বা যোগ্য অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলো বিশেষণ ।
যেমন- জল+ষ্ণীয়=জলীয় ; বায়ু+ষ্ণীয়=বায়বীয় ; শাস্ত্র+ষ্ণীয়=শাস্ত্রীয় ; দেশ+ষ্ণীয়=দেশীয় ; বঙ্গ+ষ্ণীয়=বঙ্গীয় ; ভারত+ষ্ণীয়=ভারতীয় ইত্যাদি ।
(৭) ষ্ণিক>ইক : দক্ষ বা সম্বন্ধীয় অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- অনু+ষ্ণিক=আনবিক ;
সমাজ+ষ্ণিক=সামাজিক ; তর্ক+ষ্ণিক=তার্কিক ; ন্যায়+ষ্ণিক=নৈয়ায়িক ; দেহ+ষ্ণিক=দৈহিক ;
ধর্ম+ষ্ণিক=ধার্মিক ; জগৎ+ষ্ণিক+=জাগতিক ; কায়+ষ্ণিক=কায়িক ; উপন্যাস+ষ্ণিক=ঔপন্যাসিক ।
সময়ে সম্পন্ন অর্থে ষ্ণিক>ইক : বর্ষ+ষ্ণিক=বার্ষিক ; মাস+ষ্ণিক=মাসিক ; পক্ষ+ষ্ণিক=পাক্ষিক ; সপ্তাহ+ষ্ণিক= সাপ্তাহিক ; দিন+ষ্ণিক=দৈনিক ; হেমন্ত+ষ্ণিক=হৈমান্তিক ; সময়+ষ্ণিক=সাময়িক ।
(৮) মতুপ্>মান্ : ‘আছে’ অর্থে বিশেষ্য পদের পরে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত পদগুলো
বিশেষণ । যেমন- ভক্তি+(মতুপ্)মান্=ভক্তিমান ; বুদ্ধি+মান=বুদ্ধিমান ; শক্তি+মান্=শক্তিমান ; শ্রী+মান্=শ্রীমান ; ধী+মান্=ধীমান ; অংশু+মান্=অংশুমান ; চক্ষু+মান=চক্ষুষ্মান ।
(৯) বতুপ্>বান্ : ‘মতুপ্’ বা ‘মান্’ স্থলে ‘বতুপ্’ বা ‘বান্’ হয় ।যেমন- ভগ+ (বতুপ্)বান্=ভগবান ; ধন+বান্=ধনবান ; শ্রদ্ধা+বান্=শ্রদ্ধাবান্ ; বল+বান্=বলবান ; স্বাস্থ্য+বান্=স্বাস্থ্যবান ; গুণ+বান্=গুণবান ইত্যাদি ।
(১০) ইত : জাত বা যুক্ত অর্থে বিশেষ্য পদের পরে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও
বিশেষ্য । যেমন-দুঃখ+ইত=দুঃখিত ; পুঞ্জ+ইত=পুঞ্জিত ; মূর্ছা+ইত=মূর্ছিত ; পুষ্প+ইত=পুষ্পিত ; ফল+ইত=ফলিত ; পল্লব+ইত=পল্লবিত ; মুকুল+ইত=মুকুলিত ; অঙ্কুর+ইত=অঙ্কুরিত ; লজ্জা+ইত=লজ্জিত ; ক্ষুধা+ইত=ক্ষুধিত ; কন্টক+ইত=কন্টকিত ; কুসুম+ইত=কুসুমিত ; পীড়া+ইত=পীড়িত ইত্যাদি ।
(১১) ‘ইল’ : ‘আছে’ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও বিশেষণ হয় । যেমন-
পঙ্ক+ইল=পঙ্কিল ; ফেন(ফেনা)+ইল=ফেনিল ; কুট+ইল=কুটিল ; জটা+ইল=জটিল ; সর্প+ইল=সর্পিল ;। প্রয়োগ : সর্পিল তার গতি, জটিল তার মনোভাব ।
(১২) ইমন্>ইমা : ভাব বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলোও বিশেষণ । যেমন-
গুরুর+ইমন্=গরিমন্>গরিমা ; এরূপ- লঘু+ইমন্=লঘিমা ; নীল+ইমন্=নীলিমা ; চন্দ্র+ইমন্=চন্দ্রিমা ; তনু+ইমন্= তনিমা ; দীর্ঘ+ইমন্=দ্রাঘীমা ; কালি+ইমন্=কালিমা ; মহৎ+ইমন্=মহিমা ; মধুর+ইমন্=মধুরিমা ; শ্যামল+ইমন্= শ্যামলিমা ইত্যাদি ।
(১৩) ইন্>ঈ : ‘আছে’ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলো বিশেষন । যেমন –
ধন+ইন্=ধনিন্>ধনী ; জ্ঞান+ইন্=জ্ঞানিন্>জ্ঞানী ; মান+ইন্=মানিন্>মানী ; ফণা+ইন্=ফণী । প্রয়োগ : সীতাহারা আমি যেন মনিহারা ফণী ।
(১৪) ঈন্ : ‘সম্বন্ধ’ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলো বিশ্বষণ ।
যেমন – গ্রাম+ঈন্=গ্রামীন ; কুল+ঈন্=কুলীন; কান+ঈন্=কানীন ; সর্বাঙ্গ+ঈন্=সর্বাঙ্গীন ইত্যাদি ।
(১৫) বিন্>বী : ‘আছে’ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত পদগুল বিশেষণ । যেমন-
মায়া+বিণ্=মায়াবিণ্>মায়াবী ; মেধা+বিণ্=মেধাবী ; তেজস্+বিন্=তেজস্বিন্>তেজস্বী (স্ত্রীলিঙ্গে বিনী-মায়াবিনী, তেজস্বিনী)
(১৬) তন : ‘উৎপন্ন’ বা জাত বা ভাব বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলো
বিশেষণ । যেমন- প্রাক্+তন=প্রাক্তন ; সনা+তন=সনাতন ; ঊধ্ব+তন=ঊধ্বতন ; অদ্য+তন= অদ্যতন ; পুরা+তন=পুরাতন ; চিরম্+তন=চিরন্তন । প্রয়োগ : পুরাতনে শ্রদ্ধা রাখে নূতনেরও আদর জানে ।
(১৭) ল : ‘আছে’ বোঝাতে এই প্রত্যয় ব্যবহৃত হয় । এই প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলো বিশেষণ । যেমন-
মাংস+ল=মাংসল ; শ্যাম+ল=শ্যামল ; বৎস+ল=বৎসল ; শীত+ল=শীতল ; হাত+ল=হাতল ; শ্রী+ল=শ্রীল ইত্যাদি । প্রয়োগ : শ্যামলে শ্যামল তুমি নিলিমায় নীল ।
(১৮) আলু : স্বভাবার্থে এই প্রত্যয় ব্যবহৃত হয় । যেমন- দয়া+আলু=দয়ালু ; স্বপ্ন+আলু=স্বপ্নালু ;
নিদ্রা+আলু=নিদ্রালু ; তন্দ্রা+আলু=তন্দ্রালু ; ভাব+আলু=ভাবালু । প্রয়োগ : দয়ালু হওয়া ভালো, কিন্তু স্বপ্নালু বা তন্দালু হওয়া ভালো না ।
(১৯) তা : বিশেষণ থেকে বিশেষ্য গঠন করতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন – দীন+তা=দীনতা ;
কোমল+তা=কোমলতা ; কঠোর+তা=কঠোরতা ; নম্র+তা=নম্রতা ; অবশ্য কখনো কখনো বিশেষ্য থেকে আরেক রকম বিশেষ্য করতেও এই প্রত্যয় হয় । যেমন – জন+তা=জনতা ; মানব+তা=মানবতা ; প্রতিযোগী+তা= প্রতিযোগিতা ; সহযোগী+তা=সহযোগিতা ।
(২০) ত্ব : বিশেষ্য পদ গঠন করতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- কবি+ত্ব=কবিত্ব ; প্রভু+ত্ব=প্রভুত্ব ;
পশু+ত্ব=পশুত্ব ; দেব+ত্ব=দেবত্ব ; মনুষ্য+ত্ব=মনুষ্যত্ব।
(খ) বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয় :
(১) আমি/আমো : ভাব বা অনুকরণ বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- দুষ্ট+আমি=দুষ্টামি ; জেঠা+আমি=জেঠামি ; ভন্ড+আমি=ভন্ডামি ; বাঁদর+আমি=বাঁদরামি ; ন্যাকা+আমি=ন্যাকামি/ন্যাকামো ; গোঁড়ামি=গোঁড়া+ আমি ; পাগল+আমি=পাগলামি ; গুন্ডা+আমি=গুন্ডামি ; ধূর্ত+আমি=ধূর্তামি ; পাকা+আমি=পাকামি ; নষ্ট+আমি=নষ্টামি ইত্যাদি ।
(২) আরি(আরী) : বৃত্তি বা কাজ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- কাঁসা+আরি=কাঁসারি ; পূজা+আরী=পূজারী।পূজারি ; শাঁখা+আরী=শাঁখারী>শাঁখারি ; ঝি+আরি=ঝিয়ারি ; মাঝ+আরি=মাঝারি ; রকম+আরি= রকমারি ইত্যাদি ।
(৩) ইয়া(অভিশ্রুতির ফলে ‘এ’/’ও’) : বৃত্তি, জাতি, স্বভাব, সম্বধ ইত্যাদি বোঝাতে এই প্রত্যয় হয়। যেমন – কীর্তন+ইয়া=কীর্তনিয়া ; জাল+ইয়া=জালিয়া>জেলে ; মাটি+ইয়া=মাটিয়া>মেটে ; বালি+ইয়া=বালিয়া>বেলে ; কাঁকর+ইয়া=কাঁকরিয়া>কাঁকুরে ; কাঁদন+ইয়া=কাঁদনিয়া>কাঁদুনে ; আমোদ+ইয়া=আমোদিয়া>আমুদে ;কাগজ+ইয়া=কাগজিয়া>কাগজে ; মোট+ইয়া=মোটিয়া>মুটে ; পাহাড়+ইয়া=পাহাড়িয়া>পাহাড়ে ; উত্তর+ইয়া=উত্তরিয়া>উত্তুরে ; শহর+ইয়া=শহরিয়া>শহুরে ; গাঁ+ইয়া=গাঁইয়া>গেঁয়ো ইত্যাদি ।
(৪) উয়া(‘উয়া’ অভিশ্রুতির ফলে ‘ও’) : বৃত্তি, স্বভাব প্রভৃতি বিভিন্ন অর্থে এই প্রত্যয় হয় । মাঠ+উয়া=মাঠুয়া>মেঠো ; খড়+উয়া=খড়ুয়া>খোড়া ; মাছ+উয়া=মাছুয়া>মেছো ; পান+উয়া=পানুয়া>পেনো ; জল+উয়া=জলুয়া>জলো ; টাক+উয়া=টাকুয়া>টেকো ; পড়+উয়া=পড়ুয়া>পড়ো ; গাছ+উয়া=গাছুয়া>গেছো ; ভাত+উয়া=ভাতুয়া>ভেতো ; কাঠ+উয়া=কাঠুয়া>কেঠো ইত্যাদি ।
(৫) উক : স্বভাব অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- লাজ+উক=লাজুক ; হিংসা+উক=হিংসুক ; ভাব+উক=ভাবুক ; পেট+উক=পেটুক ; নিন্দা+উক+=নিন্দুক ; মিথ্যা+উক=মিথ্যুক ; মিশ+উক=মিশুক ইত্যাদি ।
(৬) আরু : নিপুণ, স্বভাব অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- বোমা+আরু=বোমারু ; দিশ+আরু= দিশারু ; ডুব+আরু=ডুবারু ; কিন্তু সাঁতার+উ=সাঁতারু ।
(৭) আল : পেশা বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- লাঠি+আল=লাঠিয়াল ; কবি+আল=কবিআল> কবিয়াল ; আবার ‘আছে’ অর্থেও ‘আল’ প্রত্যয় হয় । যেমন – দাঁত+আল=দাঁতাল ; ‘আল’ কখনো কখনো ‘আলো’ হয় । যেমন- শাঁসালো ; জোরালো ; রসালো ইত্যাদি ।
(৮) আলি : সম্বন্ধ ও সাদৃশ্য অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন – মিতা+আলি ; ঠাকুর+আলি= ঠাকুরালি ; চতুর+আলি=চতুরালি ; ঘটক+আলি=ঘটকালি ; সোনা+আলি=সোনালি ; রূপ+আলি=রূপালি>রূপোলি ।
(৯) ই : বৃত্তি, আচরণ প্রভৃতি বোঝাতে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- ডাক্তার+ই=ডাক্তারি ; মাস্টার+
ই=মাস্টারি ; ব্যারিস্টার+ই=ব্যারিস্টারি ; পন্ডিত+ই=পন্ডিতি ; দালাল+ই=দালালি ; রাখাল+ই=রাখালি ; মজুর+ই=মজুরি ; জমিদার+ই=জমিদারি ; কবিরাজ+ই=কবিরাজি ইত্যাদি ।
(১০) ঈ : বিবিধ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন= জীবিকা অর্থে- চাষ+ঈ=চাষী ; ঢাক+ঈ=ঢাকী> ঢাকি ; তেল+ঈ=তেলী>তেলি ; দোকান+ঈ=দোকানী>দোকানি ; ব্যবসায়+ঈ=ব্যবসায়ী ইত্যাদি ।
(ঈ)আছে অর্থে : দাম+ঈ=দামী>দামি ; দাগ+ঈ=দাগী>দাগি ; ভার+ঈ=ভারী>ভারি ইত্যাদি ।
(ঈ)দক্ষ বা নিপুণ অর্থে : হিসাব+ঈ=হিসাবী>হিসাবি ; সেতার+ঈ=সেতারী>সেতারি ; শিকার+ঈ=শিকারী>শিকারি ইত্যাদি ।
(ঈ)দেয় বা প্রাপ্য বোঝাতে : দর্শন+ঈ=দর্শনী>দর্শনি ; প্রণাম+ঈ=প্রণামী>প্রণামি ; সেলাম+ঈ=সেলামী >সেলামি ; দালাল+ঈ=দালালী>দালালি ; খোরাক+ঈ=খোরাকী>খোরাকি ইত্যাদি ।
(ঈ)আগত বা উৎপন্ন অর্থে : শান্তিপুর+ঈ=শান্তিপুরী>শান্তিপুরি ; বৃন্দাবন+ঈ=বৃন্দাবনী>বৃন্দাবনি বেনারস+ঈ=বেনারসী>বেনারসি কাশ্মীর+ঈ=কাশ্মীরী>কাশ্মীরি ইত্যাদি ।
(ঈ)নির্মিত অর্থে : রেশম+ঈ=রেশমী>রেশমি ; পশম+ঈ=পশমী>পশমি ইত্যাদি ।
(ঈ)বর্ণ বোঝাতে : গোলাপ+ঈ=গোলাপি ; বেগুন+ঈ=বেগুনী ; বাদাম+ঈ=বাদামী>বাদামি ইত্যাদি ।
(১১) আই : সম্বন্ধ অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- বড়ো+আই=বড়াই ; খাড়া+আই=খাড়াই ; ঢাকা +আই=ঢাকাই ; পাটনা+আই=পাটনাই ; মোগল+আই=মোগলাই ; চোর+আই=চোরাই ; ভোর+আই=ভোরাই ইত্যাদি ।
(১২) টিয়া(টে) : স্বভাব বা অধিকারী অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন – ঝগড়া+টিয়া=ঝগড়াটিয়া> ঝগড়াটে ; বোকা+টিয়া=বোকাটিয়া>বকাটে ; ভাড়া+টিয়া=ভাড়াটিয়া>ভাড়াটে ; তামা+টিয়া=তামাটিয়া>তামাটে ।
(১৩) পনা : স্বভাব অর্থে এই প্রত্যয় হয় । যেমন- বীর+পনা=বীরপনা ; গিন্নি+পনা=গিন্নিপনা ; হ্যাংলা+পনা=হ্যাংলাপনা ; দুরন্ত+পনা=দুরন্তপনা ; বেহায়া+পনা=বেহায়াপনা ; সতী+পনা=সতীপনা ; ন্যাকা+পনা=ন্যাকাপনা ।
(১৪) পানা : সাদৃশ্য বোঝাতে ‘পানা’ প্রত্যয় হয় । যেমন- চাঁদ+পানা=চাঁদপানা ; কালো+পানা= কালোপানা ; কুলো+পানা=কুলোপানা