ভ্রমণের মূল্য
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা :
অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা ও অচেনাকে চেনার জন্য মুক্তিপাগল মন ছুটে চলে দেশ-দেশান্তরে। এগিয়ে চলাই জীবনের ধর্ম। “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে।” উপনিষদেও পাওয়া যায়- ‘চরৈবেতি, চরৈবেতি’। আর চলতে চলতে, দেখতে দেখতে আমরা নতুন নতুন শিক্ষা গ্রহণ করি। শিক্ষার যেমন কোনো শেষ নেই তেমনি তা গ্রহণের জন্য চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকার আবশ্যকতাও নেই।
ভ্রমণ :
ভ্রমন শব্দটি কানে এলেই মানুষের মনে শিহরণ জাগে, মন যেন কোথায় হারিয়ে যায়। ভ্রমণপিপাসু মানুষের মূলমন্ত্র
“থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে।”
বিশ্ব প্রকৃতির রহস্যময়ী রূপদর্শনের জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেয় দুর্গম পর্বত, নিবিড় অরণ্য, ধু-ধু মরুপ্রান্তর।
শিক্ষা :
শিক্ষার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেকানন্দের একটি উক্তি বহুল প্রচলিত-
Education is the manifestation of perfection already in man.
অর্থাৎ ‘শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ।” আর তা বিকাশের জন্য দেশভ্রমণ একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
দেশভ্রমণের উদ্দেশ্য :
‘সাধারণত আমরা বই পড়ে যে জ্ঞান লাভ করি তার চেয়ে বেশি জানতে পারি দেশভ্রমণের মাধ্যমে। কারণ ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করি। ভ্রমণের মাধ্যমে, যে-কোনো জিনিস আমাদের মনে স্থায়ীভাবে স্মৃতি আকারে জমা হয়ে থাকে। তাই আমাদের হৃদয় ও মনের প্রসার এবং চিন্তা চেতনার বিকাশের জন্য দেশভ্রমণ অপরিহার্য।
ভ্রমণ ও শিক্ষা :
ভ্রমণের সঙ্গে শিক্ষার যোগ অত্যন্ত নিবিড়। পুথিগত জ্ঞান আমাদের মনে পূর্ণতা দেয় না। পূর্ণতার জন্য প্রয়োজন দর্শন ও যথার্থ উপলব্ধি। তাই পুথিগত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তবের যোগসূত্র ঘটায় ভ্রমণ। যে ব্যক্তি কোনোদিন নদী বা সমুদ্র দেখেনি, পুথিগত বিদ্যা যতই থাকুক, নদী বা সমুদ্রের দর্শন ছাড়া সেই সম্পর্কে ধারণা তার পূর্ণতা পাবেনা। ভ্রমণের ফলে বিভিন্ন স্থানের মানুষের ভাষা, জীবনযাত্রা, রীতিনীতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যের কারণে ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের কেতাবি জ্ঞানের অস্বচ্ছতা দূর হয়। তাই দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
ভ্রমণের মূল্য :
ভ্রমণের মূল্য অপরিসীম। মানব মনের কৌতূহল জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ঘটায় ভ্রমণ। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জনের উৎসই নয় বরং এটি আনন্দেরও উৎস হিসাবে কাজ করে। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ নিতে হলে এবং সবার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে হলে দেশভ্রমণ করতে হবে। টমাস হুড ভ্রমণের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন-
” যে যত বেশি ভ্রমণ করবে তার জ্ঞান তত বেশি বৃদ্ধি পাবে।”
তাই আমাদের অভিজ্ঞতার জগতকে সমৃদ্ধ করতে তাহলে দেশভ্রমণ করতে হবে। আর এই ভ্রমণের মাধ্যমেই মানসিক সংকীর্ণতা এবং ক্ষুদ্রতা দূর করা সম্ভব।
সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও দেশভ্রমণ:
দেশভ্রমণের ফলে আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারেও সংযোজিত হয় নব নব সৃষ্টি। ভ্রমণ কাহিনি অবলম্বনে সৃষ্ট ভ্রমণসাহিত্য অতীত ও বর্তমানের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। প্রখ্যাত পর্যটক ফা-হিয়েন, মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে শুরু করে আধুনিককালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণমূলক রচনাবলি সমৃদ্ধ করেছে ভারতীয় সাহিত্যক্ষেত্রকে ও সেইসঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতিকে
উপসংহার:
শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে দেশভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। ভ্রমনের মাধ্যমে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান সুদৃঢ় হয়, মনের প্রসার ও চিত্তের প্রশান্তি ঘটায়। দেশভ্রমণের ফলে অভ্যস্ত জীবন সাময়িক মুক্তিলাভ করে জগতের আনন্দযজ্ঞে আসন পেতে বসে। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি
“গবেষণাগার ব্যতীত বৈজ্ঞানিক শিক্ষা যথাযথ হয় না- দেশভ্রমণকেও সেরূপ শিক্ষার গবেষণাগার বলা চলে।”