বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো
বৃষ্টির তৃতীয় দিনে ওরা বাড়ির ভেতরে এতই কাঁকড়া মেরেছিল যে পেলাইওকে ভিজে-একশা উঠোন পেরিয়ে গিয়ে সেগুলোকে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়েছিল, কারণ সারা রাত ধরে নবজাত শিশুটির ছিল জ্বর, আর ওরা ভেবেছিল জ্বরটা হয়েছে ওই পচা বদ গন্ধটার দরুন। মঙ্গলবার থেকেই সারা জগৎ কেমন বিষণ্ণ হয়ে আছে। সমুদ্র আর আকাশ হয়ে উঠেছে একটা ছাই-ধূসর বস্তু; আর বেলাভূমির বালি, মার্চের রাত্তিরে যা ঝকঝক করে গুঁড়ো-গুঁড়ো আলোর মতো, হয়ে উঠেছে কাদা আর পচা খোলকমাছগুলোর এক ভাপে-সেদ্ধ-হওয়া দগদগে স্তূপ। দুপুরবেলাতেই আলো এমন দুর্বল যে পেলাইও যখন কাঁকড়াগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল, তার পক্ষে দেখাই মুশকিল ছিল উঠোনের পেছন কোণটায় কী-সেটা ছটফট করে নড়তে-নড়তে কাতরাচ্ছে। তাকে খুব কাছে গিয়ে তবেই দেখতে হয়েছিল যে এক বুড়ো, খুবই থুরথুরে বুড়ো, কাদার মধ্যে মুখ গুজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, আর তার প্রচন্ড সব চেষ্টা সত্ত্বেও, কিছুতেই উঠতে পারছে না, তার বিশাল দুই ডানায় কেবলই বাধা পেয়ে যাচ্ছে।
সেই দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠে, পেলাইও ছুটে চলে গেল এলিসেন্দার কাছে, তার বউ, যে তখন অসুস্থ বাচ্চাটির কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল, আর পেলাইও তাকে ডেকে নিয়ে গেল উঠোনের পেছন কোণায়। পড়ে-থাকা শরীরটার দিকে তাকিয়ে তারা কেমন হতভম্ব হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বুড়োর পরনে ন্যাকড়াকুড়ুনির পোশাক। তার টাক-পড়া চকচকে মাথাটায় কয়েকটাই মাত্র বিবর্ণ চুল রয়েছে, ফোগলা মুখটায় খুবই কম দাঁত, আর এককালে যদি বা তার কোনো জাঁকজমক থেকেও থাকত এখন এই ঝোড়ো কাকের প্র-প্রপিতামহের করুণ দশা সে জাঁকজমক একেবারে উধাও করে দিয়েছে। তার অতিকায় শিকারি পাখির ডানা-নোংরা, আদ্ধেকটাই পালক খসা-চিরকালের মতো কাদায় জট পাকিয়ে গিয়েছে। ওরা তার দিকে এতক্ষণ ধরে খুব কাছে থেকে হাঁ করে তাকিয়েছিল যে পেলাইও আর এলিসেন্দা খানিক বাদেই তাদের প্রথম চমকটা জয় করে নিলে, বরং শেষটায় একে বেশ চেনা-চেনাই ঠেকল। তখনই সাহস করে তার সঙ্গে কথা কইবার একটা চেষ্টা করলে তারা, আর উত্তরে সে খালাশিদের যেমন গলা ফাটিয়ে কথা বলার অভ্যেস থাকে তেমনি রিনরিনে গলায় কী-এক দুর্বোধ্য বুলিতে জবাব দিলে। ওই কারণেই ওরা ডানাদুটোর ঝামেলা-টামেলাকে বেমালুম কোনো পাত্তা না দিয়েই বেশ বুদ্ধিধারীদের মতোই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে সে নিশ্চয়ই তুফানে উলটে যাওয়া কোনো ভিনদেশি জাহাজের নিঃসঙ্গ ভরাডুবি নাবিক। অথচ তবু তাকে দেখাবার জন্যে ওরা এক পড়োশিনিকে ডেকে আনলে, সে আবার জীবনমৃত্যুর সব গলিঘুঁজিরই হদিস রাখে; আর তার দিকে শুধু একবার তাকিয়েই সেই পড়োশিনির ওদের বোঝাতে দেরি হল না যে ওরা একটা মস্ত ভুল করেছে।
‘এ যে এক দেবদূত’, পড়োশিনি তাদের বললে। ‘নিশ্চয়ই বাচ্চাকে নিয়ে যেতে আসছিল, কিন্তু বেচারা এমনই বুড়োহাবড়া যে এই মুষলবৃষ্টি তাকে একেবারে পেড়ে ফেলেছে।’
পরের দিনই সবাই জেনে গেল যে পেলাইওদের বাড়িতে এক রক্তমাংসের জ্যান্ত দেবদূতকে কয়েদ করে রাখা হয়েছে। জ্ঞানে ঝুনো ওই পড়োশিনির বিচারবুদ্ধিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে-তার কাছে তখন দেবদূতমাত্রেই কোনো স্বর্গীয় ষড়যন্ত্রের পালিয়ে-বাঁচা নিদর্শন-ওরা তাকে মুগুরপেটা করে মেরে ফেলতে কোনো সায় পেলে না। রান্নাঘর থেকে পেলাইও সারা বিকেল তার ওপর নজর রাখলে, তাদের পালের খাটো মুগুরটায় সে সশস্ত্র; আর রাত্তিরে শুঁতে যাবার আগে তাকে সে কাদা থেকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে তারের জাল ঘেরা মুরগির খাঁচাটায় বন্ধ করে রাখলে। মাঝরাত্তিরে, বৃষ্টি যখন ধরে এল, পেলাইও আর এলিসেন্দা তখনও একটার পর একটা কাঁকড়া মারছে। একটু বাদেই বাচ্চাটাও জেগে উঠল মস্ত এক খাই-খাই নিয়ে, তার গায়ে আর জ্বর নেই। তখন ওরা একটু দরাজদিল হয়ে উঠল, ঠিক করলে যে এই দেবদূতকে ওরা তিনদিনের উপযোগী টাটকা জল আর খাবারদাবার দিয়ে একটা ভেলায় করে বারদরিয়ায় তার নিয়তির কাছে ছেড়ে দিয়ে আসবে। কিন্তু উষার প্রথম আলো ফোটবামাত্র যখন ওরা উঠোনে গিয়ে হাজির হল, ওরা দেখতে পেলে পুরো পাড়াটাই মুরগির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে দেবদূতকে নিয়ে মজা করছে, রঙ্গতামাশা করছে, কারু মধ্যে কোনো সম্ভ্রমবোধ নেই, তারের মধ্যে দিয়ে তাকে ছুড়ে-ছুড়ে দিচ্ছে খাবার, যেন সে আদপেই কোনো অতিপ্রাকৃত জীব নয় বরং যেন সে এক সার্কাসের জন্তু।
সকাল সাতটার আগেই পাদ্রে গোনসাগা এসে হাজির-এই অদ্ভুত খবরে বেশ শঙ্কিত হয়েই হন্তদন্ত হয়ে তিনি ছুটে এসেছেন। ততক্ষণে ভোরবেলাকার দর্শকদের মতো তত রঙবাজ নয় এমন দর্শকরা এসে হাজির হয়েছে, আর তারা বন্দির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সরল লোকটা ভেবে ফেলেছে যে একে সারা জগতের পুরপিতা নাম দেওয়া উচিত। অপেক্ষাকৃত কঠিন হৃদয়ের লোকেদের মনে হল একে এক পাঁচতারা সেনাপতির পদে উন্নীত করে দেওয়া হোক, যাতে সে সব যুদ্ধবিগ্রহই জিতিয়ে দিতে পারে। কিছু-কিছু দূরদর্শীর মনে হল তাকে দিয়ে যদি পৃথিবীতে কোনো ডানাওয়ালা জাতির জন্ম দেওয়ানো যায় তবে সে জাতি হবে জ্ঞানে-গুণে সবার সেরা, আর তারাই তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দায়িত্ব নিয়ে নেবে। কিন্তু পাদ্রে গোনসাগা, যাজক হবার আগে ছিলেন এক হট্টাকট্টা কাঠুরে-তারের বেড়ার পাশে দাড়িয়ে, তিনি মুহূর্তে জেরা করবার জন্যে প্রশ্নোত্তরে সব ভেবে নিলেন, আর ওদের বললেন দরজাটা খুলে দিতে, যাতে ভেতরে গিয়ে কাছে থেকে তিনি এই হতশ্রী করুণ লোকটাকে দেখে নিতে পারেন-যাকে তখন এই ভ্যাবাচাকা-খাওয়া মন্ত্রমুগ্ধ মুরগির ছানাগুলো মধ্যে এক অতিকায় জরাজীর্ণ মুরগির মতো দেখাচ্ছিল। সে শুয়ে আছে এক কোণায়, খোলা ডানাগুলো সে শুকোচ্ছে রোদ্দুরে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে ফলের খোসা আর ছোটোহাজরির উচ্ছিষ্ট, ভোর ভোর ওঠা দর্শকরা এসে যেসব তাকে ছুড়ে দিয়েছে। পাদ্রে গোনসাগা যখন মুরগির খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ে তাকে লাতিনে সুপ্রভাত জানালেন, জগতের ধৃষ্টতা আর ঔদ্ধত্য তার অচেনা বলে সে শুধু তার প্রত্নপ্রাচীন চোখ তুলে গুনগুন করে কী একটা বললে তার ভাষায়। এ যে এক জোচ্চোর ফেরেববাজ, এবিষয়ে এ তল্লাটের যাজনপল্লির এই পুরুতটির মনে প্রথম সন্দেহটা দানা বেঁধে উঠল, বিশেষত যখন দেখতেই পেলেন যে এ ঈশ্বরের ভাষাই বোঝে না, কিংবা জানেও না কী করে ঈশ্বরের উজির-নাজিরদের সম্ভাষণ করতে হয়। তারপর তিনি খেয়াল করে দেখলেন যে খুব কাছে থেকে নজর করলে, তাকে বড্ড বেশি মানুষ মানুষ দেখায়। তার গা থেকে বেরোচ্ছে খোলামেলার এক অসহ্য গন্ধ, তার ডানাগুলোর পেছনদিকে গজিয়েছে নানারকম পরভৃৎ আর তার প্রধান পালকগুলোর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে পার্থিব সব হাওয়া; দেবদূতদের সগর্ব মর্যাদার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমনকিছুই তার নেই। তারপর তিনি মুরগির খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং ছোট্ট একটি কথামৃত আউড়ে কৌতূহলীদের হুঁশিয়ার করে দিলেন ছলাকলাহীন সাদাসিধে অকপট লোক হবার ঝুঁকি কতটা; তিনি ওদের মনে করিয়ে দিলেন যে রোম্যান ক্যাথলিকদের হুল্লোড়ে উৎসবে এসে কৌশলে আচমকা ল্যাং মেরে দেবার একটা বিষম বদঅভ্যাস আছে শয়তানের-যাতে অসাবধানীদের সে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে, বিপথে নিয়ে যেতে পারে। তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝালেন যে-কোনো ডানা যদি কোনো বাজপাখি আর উড়োজাহাজের তফাত নির্ধারণ করে নেবার কোনো আবশ্যিক উপাদান না হয়, তবে দেবদূতদের শনাক্ত করবার বেলায় ডানার গুরুত্ব তো আরোই কম। তৎসত্ত্বেও তিনি কথা দিলেন যে তিনি তাঁর বিশপকে একটি চিঠি দেবেন যাতে বিশপ তাঁর গির্জাশাসিত পল্লির আর্চবিশপকে লিখতে পারেন, আর তিনি তারপর লিখতে পারেন সর্বোচ্চ মোহান্তকে- যাতে উচ্চতম আদালত থেকে সর্বাধিনায়কের চূড়ান্ত রায়টি পাওয়া যায়।
তাঁর বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা-সকলই গিয়ে পড়ল বন্ধ্যা সব হৃদয়ে। বন্দি দেবদূতের খবর এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে কয়েকঘণ্টা বাদেই এক বড়ো হাটবাজারের ব্যস্ততা আর শোরগোল উঠল উঠোনে, আর ভিড়কে সরিয়ে দেবার জন্যে ডাকতে হলো সঙ্গিনসমেত সেনাবাহিনীকে, নইলে বাড়িটা তারা প্রায় ধসিয়েই দিত। এই হাটবাজারের এত জঞ্জাল ঝাঁট দিয়ে দিয়ে এলিসেন্দার শিরদাঁড়া যেন দুমড়ে গিয়েছে; শেষটায় তার মাথায় খেলে গেল, আরে, উঠোনের চারপাশে বেড়া দিয়ে সকলের কাছ থেকেই তো দর্শনি বাবদ পাঁচ সেন্ট করে চাওয়া যায়।
কৌতূহলীরা এল দূর-দূরান্তর থেকে। এক ভ্রাম্যমান সার্কাস দলও এসে পৌঁছাল, যার ছিল এক উড়ন্ত দড়বাজিকর, সে ভিড়ের ওপর বার কয় ভোঁ-ভোঁও করলে, কিন্তু কেউ তার দিকে কোনো পাত্তাই দিলে না-কারণ তার ডানাগুলো মোটেই কোনো দেবদূতের মতো ছিল না-বরং সেগুলোকে দেখাচ্ছিল কোনো নাক্ষত্র বাদুড়ের মতো। জগতের সবচেয়ে দুর্ভাগা ও অশক্তরা এল স্বাস্থ্যের সন্ধানে; এল এক বেচারি মেয়ে, জন্ম থেকেই যে গুনে যাচ্ছিল তার বুকের ধুকধুক, গুনতে গুনতে এখন সে সব সংখ্যাই শেষ করে ফেলেছে; এল এক পোর্তুগিজ-কিছুতেই যে কখনও ঘুমোতে পারে না, কারণ তারাদের কোলাহল তার ঘুম কেবলই চটিয়ে দেয়; এল এক ঘুমে হাঁটা লোক, যে দিনে জেগে থাকা অবস্থায় যা-যা করেছে সব রাত্তিরে ঘুমের ঘোরে উঠে গুবলেট করে দেয়; এছাড়াও কত কত জন, তাদের অবশ্য অত ভয়াবহ সব অসুখ নেই। পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল যে জাহাজডুবির বিশৃঙ্খলা, তার মধ্যে পেলাইও আর এলিসেন্দা অবশ্য তাদের ক্লান্তিতেই সুখী, কারণ হপ্তা শেষ হবার আগেই তারা তাদের সবগুলো ঘরঠেসেছে টাকাকড়িতে, আর ভেতরে ঢোকবার পালা কখন আসে তার জন্যে যে তীর্থযাত্রীর সার অপেক্ষা করছে বাইরে, তা এমনকি দিগন্তও পেরিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে।
এই দেবদূতই ছিল একমাত্র যে তার নিজের এই হুলস্থূল নাট্যে কোনোই ভূমিকা নেয়নি। তার এই ধার-করা নীড়ে কীভাবে সে একটু আরাম পাবে, তারই চেষ্টায় সে কাটায় সারা সময়-তেলের বাতি বা উপাসনার মোমবাতিগুলোর নারকীয় জ্বালায় আর উত্তাপে তার প্রায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়, অথচ ওগুলো সারাক্ষণ ওই তারের খাঁচায় জ্বলছে। গোড়ায় তাকে ওরা ন্যাপথালিন খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল, সেই পরমজ্ঞানী পড়োশিনির প্রজ্ঞা অনুযায়ী তাই নাকি দেবদূতের খাদ্য হিসেবে বিধানবিদিত। কিন্তু সে ওসব ফিরিয়ে দিয়েছে, যেমন সে ফিরিয়ে দিয়েছে পোপের ভোজ, পাপীতাপীরা প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্যে মানত করে এসব ভূরিভোজ তার কাছে নিয়ে এসেছিল; আর তারা কখনও এটা বুঝে উঠতে পারেনি সে যে বেগুনভর্তা ছাড়া আর কিছুই খায় না, সে কি সে একজন দেবদূত বলে না কি ফোগলা দাঁতের এক বুড়ো থুরথুরে বলে। তবে একমাত্র অতিপ্রাকৃত শক্তি মনে হল তার ধৈর্য। বিশেষত প্রথম দিনগুলোয়, তার ডানায় যেসব নাক্ষত্র পরভৃৎ জম্পেশ করে গজিয়েছে তার খোঁজে যখন মুরগিরা তাকে ঠোকরাত, আর পঙ্গুরা ছিড়ে নিত তার পালক তাদের বিকল ঠুটো অঙ্গগুলোয় ছোঁয়াবার জন্যে, আর এমনকি যাদের প্রাণে সবচেয়ে দয়াধর্ম ছিল তারাও যখন তাকে তাগ করে ঢিল ছুড়ত যাতে সে উঠে পড়ে আর দাঁড়ালে তাকে কেমন দেখায় সেটা দেখবার জন্যে-তখনও সে শান্তই থাকত। একমাত্র যেবার তারা তাকে উসকে তাতিয়ে দিতে পেরেছিল সে তখনই যখন তারা তার পাশটা পুড়িয়ে ছিল তপ্ত লোহায়, যা দিয়ে ছ্যাঁকা লাগিয়ে তারা বলদের গায়ে মার্কা দিত-কারণ সে এতক্ষণ কেমন ঝিম মেরে নিশ্চল পড়েছিল যে তারা ভেবেছিল সে বুঝি মরেই গিয়েছে। আঁতকে জেগে উঠেছিল সে তখন, তার ওই রুদ্ধ দুর্বোধ্য অচেনা ভাষায় চেঁচিয়ে প্রলাপ বকেছিল, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল তার, আর সে তার ডানা ঝাপটে ছিল বার দুই, যা মুরগির বিষ্ঠা আর চান্দ্র ধুলোর এক ঘূর্ণিহাওয়া তুলে দিয়েছিল, আর এমন একটা দমকা ঝাপটা তুলেছিল আতঙ্কের যাকে কিছুতেই এই জগতের বলে মনে হয়নি। যদিও অনেকে ভেবেছিল তার সাড়াটা ঠিক ক্রোধের নয়, বরং জ্বালার, ব্যথার। আর সেই থেকে তারা হুঁশিয়ার হয়ে যায় যাতে তাকে আর এমন চটিয়ে দেওয়া না হয়, কারণ বেশিরভাগ লোকই বুঝেছিল তার এই নিষ্ক্রিয় ঔদাস্য মোটেই কোনো বীরনায়কের বিশ্রাম নয়, বরং কোনো মহাপ্লাবনের পূর্বমুহূর্তের থমথমে ছমছমে ঘুম।
বাড়ির ঝি-চাকরানিদের প্রেরণা পাওয়া সব সূত্র দিয়েই পাদ্রে গোনসাগা ভিড়ের ছ্যাবলামিটা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। বন্দির প্রকৃতি সম্বন্ধে চূড়ান্ত রায় কী আসে তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কিন্তু রোম থেকে আসা চিঠিতে কোনো তাড়াই দেখা গেল না। তারা তাদের সময় কাটিয়ে দিলে এই সব প্রশ্নে-বন্দির কোনো নাভি আছে কি না, তার কথাবার্তার সঙ্গে সিরিয়াস প্রাচীন ভাষার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, একটা ছুঁচের ডগায় তার মতো কটা মাথা এটে যায়, অথবা সে কি নিছকই নরওয়ের কোনো লোক, গায়ে ডানা লাগিয়ে নিয়েছে। ওই সব তুচ্ছ অতি সংক্ষিপ্ত চিঠিগুলো হয়তো সময়ের শেষ অব্দিই যাতায়াত করতে থাকত, যদি না এক দৈব ঘটনা পাদ্রে গোনসাগার সব নাজেহাল বিপত্তির একটা ইতি টেনে দিত।
ঘটেছিল কী, ওই দিনগুলোয়, আরো সব কত কত উৎসব মেলা আর সার্কাসের হরেকরকম বা আকর্ষণের মধ্যে, শহরে এসে পৌঁছেছিল একটি মেয়ের ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী, যে তার বাবা-মার কথার অবাধ্য হয়েছিল বলে মাকড়শা হয়ে গিয়েছে। দেবদূতকে দেখতে যত পয়সা দিতে হয়, একে দেখতে যেতে তার চেয়ে যে কম পয়সা দর্শনি বাবদ দিতে হয়, শুধু তাই নয়, তার এই অসম্ভব দশার জন্যে লোককে যা খুশি প্রশ্ন করবারও সুযোগ দেওয়া হয়, এমনকি তাকে আগাপাশতলা খুঁটিয়েও দেখতে দেওয়া হয় যাতে তার এই বিভীষিকার সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে কারো মনেই কোনো সন্দেহ না থাকে। সে এক ভয়ংকর তারানতুলা, একটা মস্ত ভেড়ার মতো বড়ো, আর তার মাথাটা এক বিষাদময়ী কুমারী মেয়ের। যা ছিল সবচেয়ে হৃদয় বিদারক, তা কিন্তু তার এই তাজ্জব আকৃতি নয়, বরং তার অকৃত্রিম দুঃখী করুণ গলা, যে গলায় সে তার দুর্ভাগ্যের সব খুঁটিনাটি বর্ণনা করত। যখন সে একেবারেই ছেলেমানুষ, এক নাচের আসরে যাবে বলে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে তার বাবা-মার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আর অনুমতি না নিয়ে সারা রাত ধরে নাচবার পর সে যখন এক বনের মধ্যে দিয়ে ফিরছিল তখন হঠাৎ এক ভয়ংকর বজ্রপাত আকাশকে দু-ভাগে ফেড়ে দিয়েছিল আর ফাটলের মধ্য দিয়ে নেমে এসেছিল জ্বলন্ত গন্ধকের এক বিদ্যুৎশিখা যা তাকে বদলে দিয়েছিল এই আজব মাকড়শায়। যাদের প্রাণে দয়াদাক্ষিণ্য আছে তারা তার মুখে মাংসের বড়া ছুড়ে দেয়-একমাত্র তাই তাকে অ্যাদ্দিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। এরকম এক দৃশ্য, যার মধ্যে এতই মানবিক সত্য আর এমন এক ভয়ংকর শিক্ষা আছে, যে তা চেষ্টা না করেও হারিয়ে দিতে পারে কোনো উদ্ধত দেবদূতের প্রদর্শনী, যে দেবদূত কিনা ক্বচিৎ কখনও নাক সিটকে তাকায় মর্ত্যবাসীদের দিকে। তাছাড়া, দেবদূতের নামে যে কটা অলৌকিক অঘটনের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা শুধু এক ধরনের মানসিক বিশৃঙ্খলাই বোঝাচ্ছিল। যেমন- এক অন্ধ আতুর, সে তার দৃষ্টি ফিরে পায়নি বটে, তবে তার তিনটে নতুন দাঁত গজিয়ে গিয়েছিল; কিংবা এক পঙ্গু বেচারি যে হেঁটে হেঁটে গিরিলঙ্ঘন করতে পারেনি বটে তবে একটা লটারি প্রায় জিতেই যাচ্ছিল; কিংবা এক কুষ্ঠরোগী যার ঘা-গুলো থেকে গজিয়েছিল সূর্যমুখী ফুল। কোনো সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো এসব অলৌকিক কাণ্ড আসলে প্রায় বিসদৃশ সব মশকরা বা কৌতুকের মতোই-আর এ সবের ফলেই দেবদূতের মানসম্ভ্রম খ্যাতি ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছিল-তারপর মাকড়শায় বদলে যাওয়া মেয়েটি আসতেই তার সব নামডাক একেবারেই ধসে পড়ল। এইভাবেই পাদ্রে গোনসাগা তাঁর অনিদ্রা রোগ থেকে চিরকালের মতো রেহাই পেয়ে গেলেন আর পেলাইওদের উঠোন সেইরকমই ফাঁকা হয়ে গেল তিনদিন তিনরাত্তির যখন একটানা ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়েছিল আর কাঁকড়ারা হাঁটছিল তাদের শোবার ঘরে।
বাড়ির মালিকদের অবশ্য বিলাপ করার কোনোই কারণ ছিল না। যে টাকা তারা কামিয়েছিল তা দিয়ে তারা এক চকমেলানো দোতলা বাড়ি বানিয়ে নিলে, সে বাড়ির ছিল অলিন্দ আর বাগান আর উঁচু তারের জাল, শীতের সময় যাতে কাঁকড়ারা আর ভেতরে ঢুকতে না পারে, আর জানালায় ছিল লোহার গরাদ যাতে কোনো পথহারা দেবদূতও ঢুকে পড়তে না পারে আচমকা। শহরের কাছেই পেলাইও একটা খরগোশ পালন করবার ঘিঞ্জি গোলকধাঁধা বানিয়ে নিলে, চিরকালের মতো ইস্তফা দিলে তারা সাধ্যপালের কাজে, আর এলিসেন্দা কিনে নিলে কতগুলো উঁচু ক্ষুরওয়ালা ঢাকা জুতো আর রামধনু-রঙা রেশমি কাপড়ের অনেক প্রস্থ পোশাক, তখনকার দিনে রোববারে রোববারে যেসব পোশাক পরত সবচেয়ে অভিজাত ও কাঙ্ক্ষিত মহিলারা। যা যা তাদের কোনো মনোযোগ পায়নি, তার মধ্যে মুরগির খাঁচাটাই একমাত্র জিনিস ছিল না। যদি তারা রাসায়নিক দিয়ে তা ধুয়ে দিয়ে থাকে আর তার ভেতরে বারবার মস্তকির অশ্রু পুড়িয়ে থাকে, সে কিন্তু মোটেই এই দেবদূতের অর্চনায় নয়, বরং সেই গু-গোবরের স্তূপের দুর্গন্ধ তাড়িয়ে দিতেই-ভূতের মতো এখনও যা ঝুলে আছে সবখানে, আর নতুন দালানটাকে বানিয়ে দিচ্ছে পোড়োবাড়ি। গোড়ায়, যখন তাদের বাচ্চা হাঁটতে শিখল, তারা খুবই সাবধানে ছিল সে যাতে কখনও মুরগির খাঁচাটার খুব কাছে না যায়। কিন্তু তারপর তারা ক্রমে ক্রমে তাদের ভয় হারাতে শুরু করল, আর গন্ধটায় অভ্যস্ত হয়ে গেল। বাচ্চার দ্বিতীয় দাঁতটি বেরোবার আগেই সে মুরগির খাঁচার ভেতরে খেলতে চলে যেত, খাঁচার তারগুলো ততদিনে অবহেলায় অযত্নে ছিঁড়ে ছিঁড়ে গিয়েছে। অন্য কোনো মর্ত্যবাসীর সঙ্গে কোনো মাখামাখিই করেনি দেবদূত, বরং দূরে দূরেই থাকত, এখনও সে তেমন একটা মাখামাখি করে না; তবে সব ভুল ধারণা হারিয়ে বসবার পর কোনো কুকুর যেমন বাচ্চাদের যাবতীয় যাচ্ছেতাই অপমান ও নিগ্রহ পরম ধৈর্যভরে সহ্য করে, তেমনি ধৈর্যের সঙ্গে দেবদূত এই বাচ্চাটিকে সহ্য করত। একই সঙ্গে দু’জনকেই পেড়ে ফেলল জলবসন্ত। যে ডাক্তার বাচ্চাটির রোগ দেখতে এসেছিল সে অবশ্য দেবদূতের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শোনবার লোভ সামলাতে পারলে না, আর সে তার বুকে এত শিস শুনতে পেলে আর এতই শোরগোল শুনতে পেলে তার বৃক্কে যে তার পক্ষে বেঁচে থাকাই সম্ভব বলে ডাক্তারের মনে হল না। যেটা তাকে সবচেয়ে তাক লাগিয়ে দিলে সেটা এই ডানা দুটোর যুক্তি ও প্রকৃতি। এ দুটি এমনই স্বাভাবিক যে পুরোপুরি কোনো মানুষেরই আবশ্যিক অঙ্গ বলে মনে হয়, আর তার অবাক লাগল এই ভেবে যে অন্য মানুষদেরই বা কোনো ডানা নেই কেন।
বাচ্চা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করল, সেটা রোদে বৃষ্টিতে মুরগির খাঁচার সম্পূর্ণ ধ্বংসের কিছুকাল পরে। দেবদূত এখন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়, পথহারা দিকভোলা কোনো মুমূর্যের মতো। ওরা তাকে ঝাঁটা মেরে বার করে দেয় শোবার ঘর থেকে, কিন্তু পরক্ষণেই তাকে দ্যাখে রান্নাঘরে, একই সঙ্গে তাকে এত বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় বলে মনে হয় যে তারা অবাক হয়ে ভাবে এর আবার আরো কতগুলো সংস্করণ হয়ে গেল নাকি-সে কি নিজেকেই তৈরি করছে বাড়ির সকল কোণায়খামচিতে? আর বিপর্যস্ত ও তিতিবিরক্ত এলিসেন্দা ডুকরে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে বলতে লাগল দেবদূতে দেবদূতে থই থই করা কোনো নরকে বাস করা কী যে জঘন্য কাণ্ড! দেবদূত এখন খেতেই পারে না কিছু, তার প্রত্নপ্রাচীন চোখও এখন এত ঘোলাটে হয়ে গেছে যে সবসময়ে সে জিনিসপত্তরে ধাক্কা খায়। তার শেষ পালকগুলোর নিছক সূক্ষ্ম জালের মতো দাঁড়গুলোই এখন আছে তার। পেলাইও একটা কম্বল ছুড়ে দেয় তার ওপর, তাকে করুণা করে একটা আটচালার নীচে শুতে দেয়। আর শুধু তখনই তারা আবিষ্কার করলে যে রোজ রাত্তিরে তার জ্বর আসে, আর কোনো বুড়ো নরওয়েবাসীর জিভজড়ানো ভাষায় সে বিকারের ঘোরে প্রলাপ বকে। যে কয়েকবার তারা বিষম ভয় পেয়ে গিয়েছিল, এ তারই একটা, কারণ তারা ধরেই নিয়েছিল যে এ বুঝি মরতে বসেছে, আর তাদের জ্ঞানীগুণী পড়োশিনি অব্দি তাদের বলতে পারলে না কোনো মরা দেবদূতকে নিয়ে তারা কী করবে।
অথচ তবু যে সে তার সবচেয়ে জঘন্য শীতকালটাই টিকে গেল তাই নয়, প্রথম রোদ্দুরে ভরা দিনগুলো আসতেই মনে হল সে ক্রমেই সেরে উঠছে। উঠোনের সবচেয়ে দূর কোণায় সে কয়েকদিন নিশ্চল পড়ে থাকে, যেখানে কেউই তাকে দেখতে পায় না; আর ডিসেম্বরের গোড়ায় তার ডানায় মস্ত কতগুলো আড় ধরা পালক গজিয়ে ওঠে, কোনো কাকতাড়ুয়ার পালক যেন সেগুলো, তার জরার আরেকটা দুর্ভাগা লক্ষণ বলেই মনে হল এই পালকগুলোকে। কিন্তু সে নিজে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিল এসব বদলের আসল কারণ, কেন-না কেউ যাতে তা না দেখতে পায় এবিষয়ে সে খুবই সজাগ ছিল, সে খুবই সাবধান ছিল কেউ যাতে শুনতে না পায় আকাশভরা ঝিকিমিকি তারার তলায় সে যখন সিন্ধুরোলের গান গুনগুন করে। একদিন সকালে এলিসেন্দা যখন পেঁয়াজকলির গুচ্ছ কাটছে, তখন আচমকা মনে হল হঠাৎ যেন দূর বারদরিয়ার এক ঝলক হাওয়া এসে ঢুকেছে রান্নাঘরে। তখন সে জানালায় গিয়ে দেখতে পেলে দেবদূত এই প্রথম তার ডানা ছড়িয়ে ওড়বার চেষ্টা করছে। কিন্তু এমনই অগোছালো ও অনভ্যস্ত তার এ অপচেষ্টা যে তার নখগুলো সবজিবাগানের মধ্যে গভীর সব খাঁজ কেটে দিচ্ছে। আর সে হয়তো তার জবুথবু উলটোপালটা ডানা ঝাপটানিতে আটচালাটাও ধসিয়ে দিত, বিশেষত বারে বারে সে যেরকম হড়কে যাচ্ছিল, কিছুতেই আঁটো করে চেপে ধরতে পারছিল না হাওয়া। তবু অবশ্য কেমন নড়বড়েভাবে সে একটু উঠতে পারল ওপরে। এলিসেন্দা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে-নিজের জন্যে স্বস্তি আর দেবদূতের জন্যেও স্বস্তি-যখন সে দেখতে পেলে যে দেবদূত এখন শেষ বাড়িগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, কোনোরকমে সে নিজেকে ধরে রেখেছে উড়ালটায়, কোনো মতিচ্ছন্ন জরাগ্রস্ত শকুনের ঝুঁকিতে ভরা ডানাঝাপটানি দিয়ে। পেঁয়াজ কাটা সারা হয়ে যাবার পরও এলিসেন্দা তাকে দেখতেই থাকে তাকিয়ে। দেখতেই থাকে যখন তাকে আর দেখাই সম্ভব ছিল না-কারণ সে তো আর তখন তার জীবনের কোনো উৎপাত বা জ্বালাতন নয়, বরং সমুদ্রের দিকচক্রবালে নিছকই কাল্পনিক একটা ফুটকিই যেন।
অনুবাদ: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো
গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪):
জন্ম দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ার আরকাটাকায়। দীর্ঘদিন সাংবাদিক হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে কাটান। মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। গদ্য সাহিত্যে ‘জাদু বাস্তবতা’ ধারার তিনিই প্রধান প্রবক্তা। একশো বছরের নিঃসঙ্গতা, কলেরার দিনগুলিতে প্রেম, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না, চিলিতে গোপনে, বিপন্ন এক নাবিকের গল্প, এই শহরে কোন চোর নেই প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত রচনা। ১৯৮২ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর জাদু বাস্তবতা ধারার পাঠ্য এই ছোটোগল্পটি ‘এই শহরে কোন চোর নেই’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো