ভূমিকা:
মাতৃভাষা প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগ। মাতৃভাষা আমরা গ্রহণ করি মায়ের কোলে বসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো’ । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষ জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। এ ভাষায় থাকে তার সহজ অধিকার। এ ভাষার সাহায্যে শিক্ষার্থী যত সহজে কোনো বিষয় অধিগত করতে পারবে অন্য ভাষায় তা পারবে না। তাই মাতৃভাষাই শিক্ষার প্রধান বাহন হওয়া উচিত।
মাতৃভাষা :
জন্মের পর থেকে শিশু যে-ভাষা শুনে শেখে বা যে ভাষার ভেতর দিয়ে বড়ো হয়ে উঠে, সেটাই তার মাতৃভাষা। যা শিশুকে আত্মীয়স্বজন, চারপাশের পরিবেশের নানা বস্তু ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। নিজের মনের ভাব, ভালোবাসা, আবেগকে যেভাবে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাতৃভাষায় প্রকাশ করা যায়, অন্য কোনো ভাষাতে তা সম্ভব নয়।
শিক্ষা ও মাতৃভাষা:-
কোনো শিশু জন্মের পর থেকেই হয় বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন বা প্রকৃতির কোল থেকে শিক্ষালাভ করতে শুরু করে। মাতৃদুগ্ধ যেমন একটি শিশুর পুষ্টিতে সম্পূর্ণতা প্রদান করে তেমন মাতৃভাষাও একটি শিশুর সঠিক শিক্ষালাভের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্র শিক্ষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা উল্লেখ করে যে, শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল মাতৃভাষা। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনও শিশুর জীবন বিকাশে মাতৃভাষাকে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম রূপে গণ্য করেছেন।
আরও পড়ুন :
শিক্ষা বিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের গুরুত্বঃ-
‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন- “ইংরেজি আমাদের পক্ষে কাজের ভাষা, কিন্তু ভাবের ভাষা নহে।” আসলে ইংরেজি ভাষা হয়তো আমাদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করে, কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রকে সুগম করতে পারে না। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব যে অপরিসীম তার কারণ হল–
১। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ফলে ভাষা ও ভাবের মধ্যে একটি সহজ যোগসূত্র তৈরি সম্ভব।
২। মাতৃভাষাই পারে বিদ্যাকে পূর্ণতা দান করতে।
৩। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ফলে আমাদের অন্তরাত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
৪। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভের ফলে শুধু জ্ঞানার্জন নয়, মানসিক শক্তির বিকাশ হতে থাকে।
৫। শিক্ষাকে গ্রহন করার পর তাকে ঠিকমতো আত্মীকরণের ব্যাপারটি মাতৃভাষার দ্বারাই সম্ভব।
শিক্ষাদানে মাতৃভাষা বনাম বিদেশি ভাষাঃ
ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজি মাধ্যম হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের অন্ধকার পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। তা দূর করা ইংরেজি ভাষার দ্বারা সম্ভব নয়, মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার দ্বারাই সম্ভব। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের ভাষা আর যাইহোক মাতৃপুজোর বোধনমন্ত্র হতে পারে না কখনোই। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই শিক্ষা দেওয়া হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব তাই কখনোই ভুললে চলবে – “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”
মাতৃভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার সঠিক মেলবন্ধন:-
যে ভাষায় শিশুর বুলি ফুটে সে ভাষা তার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে শিরায় প্রবাহিত রক্তেধারার মতো মিশে যায়। বাংলা ভাষার বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন জপদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের সুখ্যাতি আছে। তেমনি ভাষার ক্ষেত্রে অনুদার হলে চলবে না। মাতৃভাষার পাশে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাটাও থাকা উচিত। তাই সঠিক মেলবন্ধন চাই মাতৃভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার।
উপসংহার:-
আমরা কেউ ইংরেজি শিক্ষা বিরোধী নই। বাল্যকাল থেকে মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজির গুরুত্ব দেওয়া হোক সমভাবে। কিন্তু শিক্ষার্থীর প্রথম শিক্ষা তথা সর্বাঙ্গীন শিক্ষার বাহন হোক তার মাতৃভাষা। জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে পড়ুক জ্ঞানের আলো, সৃষ্টির লাবণ্য। এই প্রসঙ্গে অতুলপ্রসাদের কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায় –
“মোদের গরব মোদের আশা,
আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা।”
আরও প্রবন্ধ রচনা পড়ুন ও ডাউনলোড করুন :