ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার |একাদশ শ্রেণি |প্রথম সেমেস্টার|ভাষা|banglasahayak.com

ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার :

ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার

ভারত ভাষার অরণ্য’ এবং ‘ভারত চার ভাষাবংশের দেশ’। ভারতে প্রচলিত চারটি ভাষাবংশ হল –ইন্দো-ইউরোপীয়, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচিনা ।

Linguistic Survey of India 1903-1928 অনুসারে ভারতে ‘১৭৯টি ভাষা ও ৫৪৪টি উপভাষা’ প্রচলিত ছিল। এই গুরুতর কাজের মূল সম্পাদক ছিলেন জর্জ গ্রিয়ার্সন। ১৯৬১ সালের জনসমীক্ষাতেও দেখা যাচ্ছে মাতৃভাষার সংখ্যা প্রায় ১৬৫২টি।


এর মধ্যে অবর্গীভূত ভাষার সংখ্যা ৫৩০টি এবং অভারতীয় সংখ্যা ১০৩টি। বাকি সব ভাষাগুলি আসলে চারটি ভাষাবংশের অন্তর্গত। ইন্দো-ইউরোপীয়, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচিনা।


‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ অংশে বলা হয়েছে নৃতাত্ত্বিকদের মতে ভারতীয় জনসমূহের প্রাচীনতম স্তর নিগ্রোবটু বা নেগ্রিটো। এঁদের কিছু বংশধরদের সন্ধান মেলে দক্ষিণ ভারতে, পূর্ব ভারতের অঙ্গামি নাগা ও আন্দামানের কয়েকটি জনজাতির মধ্যে। 


অস্ট্রিক ভাষাবংশ:


Proto-Australoid বা প্রত্ন-অস্ত্রালদের ভাষার নাম ‘অস্ট্রিক’। বর্তমান ভারতের প্রায় ৬৫টি ভাষা এই ভাষাবংশজাত। অস্ট্রিক ভাষাবংশ ভারতের প্রাচীনতম ভাষাগোষ্ঠী। ‘অস্ট্রিক’ ভাষাবংশের বংশলতিকাটি হল-

অস্ট্রিক ভাষা শুধু ভারতেই নয়, এর বিস্তার ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশেও। অস্ট্রিক ভাষার দুটি শাখা-১. অস্ট্রোনেশীয় এবং ২. অস্ট্রো-এশিয়াটিক। অস্ট্রোনেশীয় শাখাটিই মূলত ছড়িয়ে গেছে ভারতের বাইরে। ইন্দোনেশিয়ার নানা ভাষার মধ্যে ‘মালয়’ প্রধান।


ভারতের প্রচলিত অস্ট্রিক শাখাটি হল অস্ট্রো-এশিয়াটিক। অস্ট্রো-এশিয়াটিকের যে তিনটি ধারা ভারতে প্রচলিত বলে ভাষাতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, (অর্থাৎ ক. পশ্চিমা, খ. মধ্যদেশীয় এবং গ. পূর্বী) তার মধ্যে পূর্বী ধারাটির অস্তিত্ব সংশয়ের ঊর্ধ্বে  নয়। তাই আমরা অন্য দুটি ধারা নিয়ে এখানে আলোচনা করব।


অস্ট্রো-এশিয়াটিকের পশ্চিমা ধারাটি বৃহত্তম, প্রায় ৫৮টি ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। শবর, কোরকু, খাড়িয়া, সাঁওতালি, মুন্ডারি, হো, ভূমিজ প্রভৃতি পশ্চিমা শাখার উল্লেখযোগ্য ভাষা। এই ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাষা হল সাঁওতালি ভাষা। প্রায় দশ রকম ভাষাবৈচিত্র্যও দেখা যায়। সাঁওতালি ভাষার প্রধান কেন্দ্রস্থল সাঁওতাল পরগনা ও ছোটনাগপুর। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে ঝাড়খণ্ড ও বিহারের পর এর প্রাধান্য পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায়। সাঁওতালি ভাষা লেখা হত বাংলা অথবা রোমক লিপিতে। বর্তমানে সাঁওতালি লিপি অলচিকি গড়ে উঠেছে এবং এই লিপির উদ্ভাবক রঘুনাথ মুর্মু। মুন্ডারি ভাষাও মিশনারিদের উদ্যোগে ভাষাতাত্ত্বিক মর্যাদা লাভ করেছে। ফাদার হফম্যানের সম্পাদনায় ১৩ খণ্ডে সংকলিত হয়েছে ‘মুন্ডারি এনসাইক্লোপিডিয়া’। বাংলায় আগত অস্ট্রিক শব্দের নিদর্শন- কদলী, অলাবু, তাম্বুল, খোকা, খুকি, খড়, খুঁটি, ঢেঁকি, ঢিল, ঢিবি, ঝিঙ্গা, চিংড়ি, মুড়কি ইত্যাদি। এমন কি, ‘বঙ্গ’ শব্দটিও অস্ট্রিক উৎসজাত।


অস্ট্রো-এশিয়াটিকের আরেকটি শাখা মোন্-খমের্, যার মধ্যে ৭টি ভাষা অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খাসি ভাষা। উত্তর-পূর্ব ভারতে খাসি-জয়ন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চলে এই ভাষাভাষী মানুষের বাস। খাসি আগে লেখা হত বাংলা হরফে, এখন লেখা হয় রোমক লিপিতে। খাসি ভাষা ছাড়াও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিকোবরি ভাষা মোন্-খমের্ শাখার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা।


দ্রাবিড় ভাষাবংশ:


ভাষাভাষীর সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম হল দ্রাবিড় ভাষাবংশ। প্রত্ন-অস্ত্রালদের পর ভূমধ্যীয় জনগোষ্ঠী (Mediterranean) ভারতে প্রবেশ করে, যাদের ভাষার নাম দ্রাবিড়। বর্তমানে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে এঁদের একচ্ছত্র বিস্তার। 


বর্তমানে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ‘ব্রাহুই’ ভাষার চিহ্ন মেলে। এ ভাষার চিহ্ন ধরেই এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয় যে সিন্ধুসভ্যতা আসলে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতাই।


দক্ষিণী শাখাটিই দ্রাবিড় ভাষাবংশের প্রধানতম শাখা। ‘তামিল’‘তেলুগু’ তামিলজাত ‘মালয়ালম্’‘কন্নড়’ দক্ষিণী শাখার উল্লেখযোগ্য ভাষার নিদর্শন। এছাড়াও নীলগিরির পার্বত্য অঞ্চলে ‘টোডা’ ও ‘কোটা’ অতি অল্পসংখ্যক আদিবাসীর ভাষা,  ‘টুলু’ এবং ‘কোডগু’ মহীশূরের অন্তর্গত কুর্গ অঞ্চলের ভাষা।


‘কুরুখ’ বা ‘ওরাওঁ’ এবং ‘মালতো’ বা ‘মালপাহাড়ি’ ভাষা উত্তরদেশীয় শাখার দুটি প্রধান ভাষা। বিহার-ওড়িশা এবং মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত অঞ্চলে ওরাওঁ ভাষা ব্যবহার করা হয়। বাংলা-ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত রাজমহল পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চলে মালতো বা মালপাহাড়ি ভাষা প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গেও ওরাওঁ ভাষায় কথা বলে এমন মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট।


মধ্যদেশীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত ভাষার সংখ্যা প্রায় সাতটি: গোণ্ডী, কোন্দ, কুই, খোন্দ, পরজি ইত্যাদি। কুই, কোন্দ, খোন্দ এ সবগুলি ভাষাই দেখা যায় ওড়িশায়। এছাড়া ‘খোন্দ’ অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এমনকি আসামে, পরজি ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলায় প্রচলিত।


ভারতে দ্রাবিড় ভাষাবংশের অন্তর্গত এতগুলি ভাষার মধ্যে প্রধান ভাষা চারটি: তামিল, মালয়ালাম্, তেলুগু এবং কন্নড়।


তামিলনাড়ু, কেরালা ও মহীশূরের বেশ কিছু অংশে তামিল ভাষা প্রচলিত। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৬ কোটি ৭ লক্ষ ৯৩ হাজার ৮১৪ জন তামিল ভাষা বলেন। তামিলের নিজস্ব লিপিটি প্রাচীন ব্রাহ্মীর দক্ষিণদেশীয় বিভেদ ‘গ্রন্থিলিপি‘ থেকে বিবর্তিত। তামিল ভাষায় ব্যবহৃত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১২টি (a, ā, i, iu, ū, e, ē, o, ō, ai, au) এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা ১৮টি। মহাপ্রাণ ও ঘোষবর্ণ নেই। তামিল লিপিতে যুক্তব্যঞ্জনের কোনো ব্যবহার নেই।


মালয়ালম্ ভাষা সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে প্রাচীন তামিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং ত্রয়োদশ শতকে এর স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ঘটে। কেরল ও লাক্ষাদ্বীপের প্রধান ভাষা। মালয়ালমের লিপি অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষার মতোই ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত এবং এই ভাষায় যাবতীয় সংস্কৃত বর্ণমালা প্রচলিত। ২০০১-এর জনগণনা অনুযায়ী ভারতে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ৬৬ হাজার ৩৯২ জন মালয়ালম্ ভাষায় কথা বলে।


কন্নড় ভাষা কর্ণাটক রাজ্যের প্রধান ভাষা হলেও কর্ণাটক রাজ্যের কাছাকাছি অন্যান্য রাজ্যের অংশগুলিতেও (যেমন মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র এবং কেরল) প্রচলিত। ২০০১-এর জনগণনা অনুসারে ভারতে কন্নড় বলেন প্রায় ৩ কোটি ৭৯ লক্ষ ২৪ হাজার ১১ জন। কন্নড় ভাষা তামিল থেকে উদ্ভূত; প্রাচীনতম দ্রাবিড়ীয় শিলালিপি (৪০০ খ্রি,) কন্নড় ভাষাতেই লেখা হয়েছিল। কন্নড় লিপি প্রতিবেশী তেলুগুর অনুরূপ। তামিল ভাষার সঙ্গে কন্নড়ের যোগ খুব বেশি হলেও লিপির ক্ষেত্রে যোগ তেলুগুর সঙ্গেই বেশি।


ভাষাভাষীর সংখ্যার দিক থেকে ভাষাবংশের মধ্যে ভারতে প্রথম স্থান তেলুগু ভাষার। ২০০১ সালের জনগণনায় দেখা গেছে ভারতে প্রায় ৭ কোটি ৪০ লক্ষ ২ হাজার ৮৭৬ জন তেলুগু ভাষায় কথা বলে। তেলুগু ভাষার প্রচলনস্থান প্রধানত অন্ধ্রপ্রদেশ। তেলুগু লিপি কন্নড় লিপির সঙ্গে অভিন্ন। ব্রাহ্মী লিপির সন্ততি পল্লব লিপি থেকে খ্রিস্টীয় ১০০০ অব্দে তেলুগু লিপি বিশিষ্টতা অর্জন করে।


ঋগ্বেদের বেশ কিছু শব্দ দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে, যেমন ময়ূর, খাল, বিল ইত্যাদি; সংস্কৃত ভাষাতেও অণু, গণ, পুষ্প, পূজা, তন্ডুল প্রভৃতি শব্দ এসেছে এবং সেগুলি বর্তমানে তৎসম শব্দ হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত। বাংলায় পিলে, উলু,খাল, গুঁড়ি, জেলা প্রভৃতি শব্দ দ্রাবিড়জাত। 

ভোটচিনা ভাষাবংশ:


নৃতাত্ত্বিকরা অনেকাংশেই নিশ্চিত যে ভারতে আর্য আগমনের আগেই মঙ্গোলয়েডরা ভারতে প্রবেশ করেন। মঙ্গোলয়েডরা যে ভাষায় কথা বলতেন তাঁদের সেই ভাষাকে ভোটচিনা বলা হয়। এই ভোটচিনার প্রধান দুটি শাখা-(১) তাইচিনা ও (২) ভোটবর্মী। আরও একটি শাখার কথা পাওয়া যায়, যার নাম য়েনিসি (yenissi)। এর সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। ভোটবর্মী শাখা ভারতবর্ষের হিমালয় অঞ্চলে প্রচলিত। 

ভোটধর্মী শাখাভুক্ত উত্তর-পূর্ব সীমান্তে বা ‘নেফামণ্ডলে বা অরুণাচল প্রদেশ এবং আসামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ২৪টিরও বেশি ভাষা পাওয়া যায়, যার মধ্যে প্রধান হল আকা, আবর, দফলা, মিসমি এবং মিরি।


আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর এইসব অঞ্চলে যে ভাষাগুলি দেখতে পাওয়া যায়, তার প্রধানত চারটি ভাগ-


১. বোরো বা বোডো:– এই শ্রেণিভুক্ত প্রায় ২২টি ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাছারি, রাভা, কোচ, গারো ও মেচদের ভাষা, ত্রিপুরা রাজ্যের টিপ্পা ইত্যাদি।


২. নাগা:– প্রধানত নাগাল্যান্ড ও মণিপুর, কিছুটা অরুণাচল প্রদেশ ও আসামে এই শাখার ভাষাগুলি ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে প্রধান হল-আও, অঙ্গামি, সেমা, তঙ্গখুল, লোথা ইত্যাদি।


৩. কুকিচিন:- আসামের লুসাই পার্বত্য অঞ্চল, মণিপুর এবং ত্রিপুরা রাজ্যে এই শাখার যে ভাষাগুলি প্রচলিত তার মধ্যে প্রধান ঐতিহ্যবাহী মণিপুরের মেইতেই ভাষা। এছাড়াও, লুসাই বা মিজো এবং

কুকি ভাষাও উল্লেখযোগ্য।


৪. বর্মি:- যদিও বর্মি ব্রহ্মদেশের ভাষা তবে, চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলের মোঘ ও ম্রু এই শাখার অন্তর্গত।


তাইচিনা বর্গের শ্যামীয় শাখার মধ্যে খামতি উত্তর-পূর্ব আসাম ও অরুণাচল প্রদেশের প্রান্তীয় অঞ্চলে প্রচলিত। খ্রিস্টীয় ১৩০০ থেকে ১৮০০ শতক পর্যন্ত আহোম ভাষা আসামে প্রচলিত ছিল (আহোম থেকেই আসাম শব্দের উৎপত্তি)।


আধুনিক বাংলায় এই ভাষাবংশ থেকে বেশ কিছু শব্দ চলে এসেছে। যেমন, বর্মী ভাষা থেকে লুঙ্গি, চিনা ভাষা থেকে চা, লিচু প্রভৃতি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top