জানা-অজানা রবীন্দ্রনাথ :
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আদি পদবি ছিল ‘কুশারী’। তারা ছিলেন শাণ্ডিল্য গোত্রের ব্রাহ্মণ। আগেকার দিনে নিচু শ্রেণির হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের অনেক সময় ‘ঠাকুর’ বলতেন, এভাবেই তাদের পদবি ‘ঠাকুর’ হয়ে যায়। ঠাকুর বাড়িতে রোজ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক আসতেন। তাদের কাছেই বালক রবীন্দ্রনাথকে পড়তে বসতে হতো। পাশাপাশি চলত সঙ্গীত, চিত্রকলা, শারীরবিদ্যা শিক্ষা। এমনকি শরীরচর্চাও করতে হতো নিয়ম মেনে প্রতিদিন ভোরবেলা। সে সময়ের বিখ্যাত কুস্তিগির হিরা সিংয়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ কুস্তিবিদ্যা শিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঘুম ছিল খুব কম। গভীর রাতে ঘুমাতেন, উঠতেন শেষ রাতে। সাধারণত তার দিন শুরু হতো স্নানান্তে উপাসনায়-ঠিক ভোর ৪টায়। ভোর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কবি একটানা লিখতেন। সকাল ৭টায় প্রাতরাশ সেরে আবার লেখা। ফাঁকে ফাঁকে হতো চা বা কফি পান। বেলা ১১টা পর্যন্ত লিখতেন। এরপর পুনরায় স্নান করে দুপুরের খাবার খেতেন। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাতেন না। এমনকি এ সময় তিনি বিশ্রামও নিতেন না। পত্রিকা বা বইয়ের পাতা উল্টিয়ে সময় কাটিয়ে দিতেন। বিকেল ৪টায় চা, সঙ্গে নোনতা কিছু। রাতের খাবার খেতেন সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে। এ সময় তিনি ইংরেজি খাবার পছন্দ করতেন। অথচ দুপুরে খেতেন বাঙালি খাবার। রাতে খাবার পর একটানা রাত ১২টা পর্যন্ত লেখা বা পড়া ছিল নিয়মিত বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা। উপাসনা বা সভা সমিতিতে যাওয়ার সময় জোব্বা ছাড়াও সাদা ধুতি, জামা ও চাদর ব্যবহার করতেন। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমী উত্তরীয় ব্যবহার করতেন। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি, বসন্তে বাসন্তী। কখনো কখনো জোব্বার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে উত্তরীয় পরতেন। বৃক্ষপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য উদ্ভিদ আর ফুলের নাম। শুধু কাব্যেই উল্লেখ রয়েছে ১০৮টি গাছ ও ফুলের নাম। এর মধ্যে বেশ কিছু বিদেশি ফুলের বাংলা নাম তিনি দিয়েছিলেন। অগ্নিশিখা, তারাঝরা, নীলমণিলতা, বনপুলক, বাসন্তী এগুলো তারই দেয়া নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ক এই তথ্যগুলো হয়তো অনেকেরই অজানা নয়। তারপরও নবীন প্রজন্মের কাছে কবিগুরুর তুলনামূলক কম পরিচিত বিভিন্ন দিক তুলে ধরতেই এই প্রয়াস। যেমন এই আগস্ট মাসেই তার প্রয়াণ দিবস। আবার এই মাসেই (১৯৪০ এর ৭ আগস্ট) অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে `ডক্টর` উপাধি দিয়েছিলেন। অবশ্য এসব কিছুর অনেক আগেই তিনি ‘বিশ্বকবি’ উপাধিতে ভূষিত হন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ই প্রথম কবিকে বিশ্বকবি বলেন। ঘটনাটি হলো, ব্রহ্মবান্ধব সে সময় ‘সোফিয়া’ পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। ১৯০০ সালে তিনি এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধের শিরোণাম ছিল ‘দি ওয়ার্ল্ড পোয়েট অব বেঙ্গল’। বুঝতেই পারছেন, এই প্রবন্ধেই তিনি কবিকে পাঠকের কাছে বিশ্বকবি বলে পরিচয় করিয়ে দেন। ভানুসিংহ ঠাকুর যে রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম সেটা অনেকেরই জানা। তার আরো কয়েকটি ছদ্মনাম ছিল। যেমন দিকশূন্য ভট্টাচার্য, অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালী, পাকড়াশি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারী নিয়েও রয়েছে অনেক গল্প। প্রজাদের তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তিনি নিজেও হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিতে পছন্দ করতেন। ‘হেলথ কো-অপারেটিভ’ তৈরি করে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা ভারতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম চালু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষি ও পশুপালন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তারা ফিরে এসে শিলাইদহ ও পতিসরে ৮০ বিঘা জমি নিয়ে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র তৈরি করেন। পাশাপাশি তৈরি করা হয় ল্যাবরেটরি। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’ চালু করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নোবেল প্রাইজের টাকা দিয়ে তিনি কৃষকদের সুবিধার কথা ভেবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হতো। ব্যাংক চলেছিল কুড়ি বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। সুতরাং তার রচনা নিয়ে এবার আলেচনা করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বই ‘কবি কাহিনী’ প্রকাশিত হয় কবির অজান্তে ১৮৭৮ সালের ৫ নভেম্বর। কবি তখন বিলেতে। কবিবন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ বইটি প্রকাশ করে কবির কাছে পাঠিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবিগুরুর মোট ৩১১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় ৮৮টি গ্রন্থ। প্রশান্ত মহলানবিশ একবার হিসাব করে দেখেছিলেন যে গল্পগুচ্ছসহ রবীন্দ্রনাথের ১৮টি গ্রন্থে মোট ৮,৬৩,৩১০টি শব্দ আছে। তার মধ্যে `আমি` আছে ৭,৭৩৭ বার এবং `তুমি` আছে ৩,১৪৭ বার। গবেষকদের মতে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম গান হচ্ছে তার খুড়তুতো দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম আননে’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত। এখন রবি ঠাকুরের গান বলতে বুঝায় তার রচিত ও সুরারোপিত গান। অথচ রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে রবি ঠাকুরের গান বলতে বুঝাত তার গাওয়া গান। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গানের সংকলন প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। ‘গীতবিতান’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। ঠাকুর পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের লোক, যিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে গান শিখে বিভিন্ন জায়গান গান গেয়েছেন এবং পরে রেকর্ড করেছেন তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী অমলা দাশ। রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম ডিস্ক বেরোয় ১৯০৫ সালে। একপিঠে ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ অন্যপিঠে স্বরচিত ‘সোনার তরী’ কবিতার আবৃত্তি। রেকর্ডে প্রথম ‘রবীন্দ্রসংগীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল কনক দাশের গাওয়া ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত একটি রেকর্ডে। পূর্বে রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে লেখা হতো ‘রবীন্দ্রগীতি’ বা কখনও ‘কথা ও সুর : রবীন্দ্রনাথ’ কিংবা কেবলমাত্র বন্ধনীর মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ’ অথবা ‘আধুনিক’। রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন ১৮৭৭ সালে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা `এমন কর্ম আর করব না` নাটকে। নাটকে তিনি অলীকবাবুর ভূমিকায় মঞ্চে উঠেছিলেন। তখন তার বয়স ১৬ বছর। নিজের লেখা নাটকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন ‘বাল্মিকী প্রতিভা’য় বাল্মিকীর ভূমিকায়। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় জোড়াসাঁকোয় ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। অভিনয়ের জন্যে রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চে মোট ১০১ বার উঠতে হয়েছিল। তার অভিনয় দেখে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথই দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।` শুরুতে বিক্ষিপ্তভাবে আঁকলেও রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ছবি আঁকতে শুরু করেন ১৯২৮ সালে। তখন তার বয়স ৬৭ বছর। ১৯০১ থেকে ১৯৪০ এ সময় তিনি এঁকেছিলেন প্রায় তিন হাজার চিত্রকর্ম। শান্তিনিকেতনের বাইরে তার ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় ফ্রান্সের প্যারিসে ১৯৩০ সালে। প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। দেশ বিদেশের বহু শিল্পী রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছবি আঁকেন তার দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সময়টা তখন ১৮৮১ সাল। অনেক পাঠক হয়তো জেনে অবাক হবেন কবিগুরু চমৎকার বলডান্স্ করতে পারতেন। তাকে নাচ শিখিয়েছিলেন খুড়তুতো দিদি সত্যেন্দ্রবালা ঠাকুর। রবীন্দ্রনৃত্য বলতে এখন যা বুঝায়, রবীন্দ্রনাথ নিজে এই নৃত্যশৈলীকে বলতেন ‘ভাবনৃত্য’। জাভা দেশের নৃত্যের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ থেকে এই শৈলীর জন্ম। মণিপুরি, কথাকলি, ভরতনাট্টম, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিনাচ, জাভার নৃত্যভঙ্গি- নানা দেশের নানা ধরনের নৃত্যশৈলী দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি নিজস্ব নৃত্যশৈলীর জন্ম দিয়েছিলেন। তবে তিনি সবসময় বলতেন, ‘নাচের টেকনিক যেন গানের ভাবকে ছাড়িয়ে না যায়।’ ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চস্থ করেন ‘নটীর পূজা’। নিউ থিয়েটার্স সেই অভিনয়ের সবাক চিত্র তুলে রাখে। `নটীর পূজা` প্রথম মুক্তি পায় চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে ১৯৩২ সালের ২২ মার্চ। নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনিচিত্রের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্ররূপ `মানভঞ্জন` মুক্তিলাভ করে ১৯২৩ সালে। রবীন্দ্র-কাহিনিভিত্তিক প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নাম `চিরকুমার সভা`। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ছবিটি পরিচালনা করেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। ছবিটি ১৯৩২ সালের ২৮ মে চিত্রায় মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নয় এমন চলচ্চিত্রে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয় প্রমথেশ বড়ুয়ার `মুক্তি` ছবিতে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। পঙ্কজকুমার মল্লিকের সংগীত পরিচালনায় ছবিটিতে কানন দেবীর কণ্ঠে দুটি এবং পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে দুটি মোট চারটি রবীন্দ্রসংগীত স্থান পেয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন প্রথম পালন করা হয় ১৮৮৭ সালে, পার্ক স্ট্রিটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। কবিগুরুর প্রথম জন্মোৎসব পালনের কৃতিত্ব দাবি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ভাগনি সরলা দেবী চৌধুরানী। কবির পঞ্চাশ বছর পূর্তি জন্মোৎসবে টাউন হলের এক সভায় অজিতকুমার চক্রবর্তী `রবীন্দ্রনাথ` নামে প্রবন্ধ পাঠ করেন। পরে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটিই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা বই। ১৯২৮ সালে অর্থাৎ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের দেহের ওজনের সমপরিমাণ ওজনের বই বিশ্বভারতী থেকে অন্যান্য সাধারণ গ্রন্থাগার ও প্রতিষ্ঠানকে দান করা হয়।