বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ |একাদশ শ্রেণি |প্রথম সেমেস্টার|ভাষা|banglasahayak.com

 বাংলা  ভাষার  উদ্ভব  ও  ক্রমবিকাশ :


ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর যে শাখাটি ভারতে প্রবেশ করে সেই শাখার নাম ভারতীয়-আর্য। খ্রিস্ট জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এই শাখার অনুপ্রবেশ এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বছরেরও বেশি সময় জুড়ে এই ভারতীয় আর্য ভাষা নানা রূপে ভারতের নানা অংশে ছড়িয়ে আছে।


এই সাড়ে তিন হাজার বছরের ভারতীয় আর্য ভাষার ইতিহাসকে তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়। 


(১) প্রাচীন ভারতীয় আর্য (Old Indo-Aryan = OIA): 

আনুমানিক ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৬০০ খ্রিঃ পূঃ পর্যন্ত। 

এ যুগের আর্যভাষার নাম দিতে পারি-বৈদিক ভাষা বা ব্যাপক অর্থে সংস্কৃত ভাষা। 

এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ঋগ্বেদ– সংহিতা।


(২) মধ্য ভারতীয় আর্য (Middle Indo-Aryan = MIA): 

আনুমানিক ৬০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

 এ যুগের আর্যভাষার নাম পালি- প্রাকৃত-অপভ্রংশ। 

অশোকের শিলালিপির প্রাকৃত, সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত, জৈন ধর্মগ্রন্থে ও কিছু স্বতন্ত্র রচনায় ব্যবহৃত প্রাকৃত, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে ব্যবহৃত পালি এ যুগের ভাষার নিদর্শন।


(৩) নব্য ভারতীয় আর্য (New Indo-Aryan = NIA): 

আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। 

বিভিন্ন নব্য ভারতীয় আর্যভাষার নাম বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পঞ্জাবি, অবধী ইত্যাদি। নানা সাহিত্যগ্রন্থ ও আধুনিক ভারতীয় আর্যদের মুখের ভাষাই এর নিদর্শন।


১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য :


প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীনতম নমুনা ঋগ্বেদ। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার মধ্যে আছে দুটি পর্যায়- (১) বৈদিক ভাষা ও সাহিত্য এবং (২) সংস্কৃত। সুতরাং এ কথা মনে রাখা উচিত যে বেদ সংস্কৃত ভাষায় লেখা নয়। সংস্কৃতকে বলা যেতে পারে বৈদিক ভাষারই বিবর্তিত ও ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ। আসলে যে-কোনো ভাষারই থাকে যেমন একদিকে লেখা ভাষা, অন্যদিকে থাকে আঞ্চলিক কথ্য বা লৌকিক ভাষা। এক্ষেত্রে, প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার কিছু আঞ্চলিক ও লৌকিক রূপ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছিল। যখন লৌকিক ভাষার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে সৃষ্টি হল ব্যাকরণে ও প্রয়োগে বিশৃঙ্খলা, তখন তাকে নিয়মবন্ধ করে শিষ্ট লেখ্য ভাষায় পরিণত করেছিলেন পাণিনিপাণিনি পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বৈয়াকরণ। কারণ, যেভাবে তিনি একটি বহু শাখায়িত ও জটিল ভাষাকে বিশ্লেষণ করেছেন, এবং পরিণত করেছেন শিষ্ট ভাষায় তা এককথায় অতুলনীয়। এই পুরো কাজটি তিনি আটটি অধ্যায়ে ব্যাখ্যা ও বিবৃত করেছিলেন বলে তাঁর ব্যাকরণের নাম অষ্টাধ্যায়ী


অশ্বঘোষ, কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি, বিশাখদত্ত, শূদ্রক প্রমুখ কবি ও নাট্যকারদের রচনায় এই ভাষার নিদর্শন আছে। 

২. মধ্য ভারতীয় আর্য :


সংস্কৃত ছিল প্রধানত শিক্ষিত লোকের ভাব বিনিময়ের ভাষা বা সাহিত্যের ভাষা। ক্রমেই বৃহত্তর জনসাধারণের মুখের ভাষা থেকে দূরে সরে সাহিত্যের ভাষারূপে প্রতিষ্ঠালাভ করলেও সাধারণ মানুষের মুখে সংস্কৃতের আর-একটি রূপ সমান্তরাল গতিতে তৈরি হচ্ছিল। যে ভাষা বৈদিক ঐতিহ্যাশ্রয়ী কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ভাষা নয়, অথবা ব্যাকরণের কঠিন নিয়মকে মান্যতা দিয়ে সে ভাষা চলছিল না। বরং; তদানীন্তন সমাজের দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠীর সংযোগের ফলে এই ভাষার নমনীয়তা গিয়েছিল বেড়ে। এর নাম আমরা দিতে পারি লৌকিক বা কথ্য সংস্কৃত এবং ধীরে ধীরে এভাবেই কথ্য সংস্কৃতের ক্রমবিবর্তনের ফলেই সাধারণের মুখের ভাষা হয়ে দাঁড়ায় প্রাকৃত ভাষা

এই প্রাকৃত শব্দটির উদ্ভবের মধ্যে দুটি দিক আছে। একটি হল প্রাকৃত শব্দটি ‘প্রকৃতি’ থেকে জাত। প্রকৃতি শব্দের অর্থ হল মূল উপাদান। অর্থাৎ, এই যে প্রাকৃত ভাষা তার মূল উপাদান বৈদিক সংস্কৃত ভাষা। এই যে প্রাকৃত ভাষা তার মূল উপাদান বৈদিক সংস্কৃত ভাষা থেকে যেহেতু এই নতুন ভাষাটি এল তাই তার নাম হল প্রাকৃত। আবার অন্য অর্থে যেহেতু শিক্ষিত লোকের থেকে সরে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভাষারূপে এর উদ্ভব, তাই জনগণের ব্যবহৃত ভাষা বা প্রাকৃত জনের ভাষা বলে এর নাম প্রাকৃত ভাষা। সময়ের দিক থেকে ৬০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পর্বের প্রধান ভাষা হল প্রাকৃত ভাষা, আর এই পর্বটির নাম মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষাকে যেমন ‘সংস্কৃত’ আখ্যা দিলে ভুল হয়, তেমনি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাকে শুধু ‘প্রাকৃত’ বললেও সেই একই ভুল হয়। যাই হোক মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন অশোকের শিলালিপি এছাড়াও ধর্মসাহিত্যের ভাষা হিসেবে ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃত ও পালি।


মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তরের একটি ভাষারূপ হল পালি। হীনযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধদেবের বাণী যে ভাষায় প্রচার করেছিলেন তা-ই পালি ভাষা। 

পালি ভাষায় রচিত নিদর্শনগুলির মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলি, বিশেষত ত্রিপিটক এবং বুদ্ধের জীবনকাহিনি নিয়ে লেখা ‘জাতকের গল্প‘ উল্লেখযোগ্য। ‘সুত্তনিপাত‘ ও ‘থেরগাথা‘ পালিভাষায় লেখা উৎকৃষ্ট কবিতা সংকলন।


মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার ব্যাপ্তি প্রায় দেড় হাজার বছর এবং এই দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে স্বাভাবিক নিয়মে এই পর্বের আর্য ভাষার নানা স্থানিক বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে থাকে। যেমন ১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, শৌরসেনী প্রাকৃত, পৈশাচী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত এবং অর্ধমাগধী প্রাকৃত-এই আঞ্চলিক রূপ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত আদর্শ প্রাকৃত হিসেবে নাটকে বা কাব্য কবিতায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সংস্কৃত নাটকে শিক্ষিত রমণী, রাজপুরুষের সংলাপে শৌরসেনী প্রাকৃত ব্যবহৃত হত। পৈশাচী প্রাকৃতের সাহিত্যিক নিদর্শন খুব বেশি নেই। মাগধী প্রাকৃতের নামের মধ্যে মগধের উল্লেখ থাকায় মনে হয় এ ভাষা পূর্ব ভারতে প্রচলিত ছিল। এর প্রাচীনতম নিদর্শন আছে সুতনুক প্রত্নলিপিতে। অর্ধমাগধীর ব্যবহার জৈন ধর্মসাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বলে অনেকে ‘জৈন প্রাকৃত’ বলেন ।


এর পরবর্তীকালের স্তরকে অপভ্রংশের স্তর বলা হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে সবকটি প্রাকৃতেরই পরবর্তী পরিণতি হল অপভ্রংশ; অর্থাৎ শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে শৌরসেনী অপভ্রংশ, মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত থেকে মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ ইত্যাদি। আবার অপভ্রংশের পরবর্তী স্তরের নাম অপভ্রষ্ট বা অবহট্ট। যদিও অনেক ভাষাবিজ্ঞানী এই অবহট্টকে আলাদা করতে চাননি। অবহট্‌ঠকে অপভ্রংশেরই অন্তর্গত করে দেখতে চেয়েছেন। তবে এই পর্যায়ে এসেই শেষ হল মধ্যভারতীয় আর্যভাষার কাল।

৩. নব্য ভারতীয় আর্য : 


নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তার ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা বলতে কোনো একটা ভাষা বোঝায় না। বরং মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার শেষতম স্তরে যে নানান আঞ্চলিক রূপ ফুটে উঠেছিল, নবম শতকে সেখান থেকেই ক্রমে জন্ম নিল আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলি। 


পৈশাচী প্রাকৃত-অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিল সিন্ধি, পশ্চিমা ও পূর্বী পাঞ্জাবি। শিখদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ গ্রন্থসাহিব এই পূর্বী পাঞ্জাবি ভাষায় গুরমুখী লিপিতে লেখা। 


মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত-অপভ্রংশ থেকে এসেছে মারাঠী ও কোঙ্কনী। মারাঠী প্রচলিত মহারাষ্ট্রে, কোঙ্কনী গোয়ায়। মারাঠী আর কোঙ্কনী দক্ষিণ ভারতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ আর্য ভাষা।


শৌরসেনী প্রাকৃত-অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিয়েছে নেপালি, কুমায়নি আর গাড়োয়ালী। গুজরাতি ও রাজস্থানি ভাষা দুটিও এসেছে শৌরসেনী প্রাকৃত-অপভ্রংশ থেকে।


অর্ধমাগধী প্রাকৃত-অপভ্রংশ থেকে তিনটি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার আবির্ভাব ঘটে। অবধী, বাঘেলী ও ছত্তিশগড়ী। এই তিনটিকে একত্রে পূর্বী হিন্দিও বলা হয়।


মাগধী প্রাকৃত-অপভ্রংশ আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের মাতৃভাষা ও প্রতিবেশী ভাষাগুলি এসেছে এখান থেকেই। মাগধী ভাষাগুলি দুটি শাখায় বিভক্ত-পূর্বী ও পশ্চিমা। পশ্চিমা শাখা থেকে এসেছে ভোজপুরি, মগহী এবং মৈথিলি ভাষা। আর পূর্বী শাখা থেকে এসেছে আসাম আর ওড়িশার অহমিয়া ও ওড়িয়া ভাষা এবং অবশ্যই বাংলা ভাষা যা পশ্চিমবাংলা, ঝাড়খণ্ড-বিহার-আসামের কিছু অংশে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলিত। 


আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দকে যদি বাংলা ভাষার জন্মসাল ধরি, তাহলে আজ বাংলাভাষার বয়স হাজার বছরের কিছু বেশি।


সাধারণভাবে চর্যাপদের ভাষাকেই ধরা হয় বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা। 


বাংলাভাষার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত, এই দীর্ঘ সময়ে তার যে বিবর্তনপথ তাকে ভাষাতাত্ত্বিকেরা য়েকটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন:


১ম পর্যায়: প্রাচীন বাংলা 

আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ


২য় পর্যায়: মধ্য বাংলা


আদি-মধ্য বাংলা 

আনুমানিক ১২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ


অন্ত্য-মধ্য বাংলা 

আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০/১৮০০ খ্রিস্টাব্দ


৩য় পর্যায়: আধুনিক বাংলা 

আনুমানিক ১৭৬০/১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত


প্রাচীন বাংলার প্রধান নিদর্শন যে চর্যাপদ তা আগেই বলেছি। এছাড়াও ‘অমরকোষের’ সর্বানন্দ রচিত টীকায় প্রদত্ত চারশোর বেশি প্রতিশব্দে, ধর্মদাস রচিত ‘বিদগ্ধ মুখমণ্ডল‘ বইয়ে কয়েকটি কবিতায় এবং ‘সেক-শুভোদয়া’য় উদ্ধৃত গানে ও ছড়ায় প্রাচীন বাংলার চিহ্ন রক্ষিত আছে।


আদি-মধ্য বাংলার নিদর্শন হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে ধরা হয়। আদি-মধ্য বাংলার বিস্তৃতিকাল যেহেতু ১৩৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, তাই এই দেড়শো বছর ব্যাপী সময়ের একটিমাত্র নিদর্শন ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে এক অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। এই দীর্ঘ সময়ে আর কোনো সাহিত্যিক রচনা সম্ভব হয়নি। এই সময়কে ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বা অনুর্বর পর্ব বলে অভিহিত করা হয়।

১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই আড়াইশো বছরের বাংলা ভাষার ধরনটিকে আমরা অন্ত্য-মধ্য বাংলা বলতে পারি। এই সময়ের সাহিত্যিক নিদর্শন প্রচুর। বৈষ্ণব পদাবলি, চৈতন্যজীবনী, মঙ্গলকাব্যসমূহ, আরাকান রাজসভাশ্রিত সাহিত্য, গীতিকা, নাথসাহিত্য-প্রভৃতি পর্যাপ্ত সাহিত্যিক নিদর্শন এ সময়ে পাওয়া যায়। এ সময়ের বাংলা যেন অনেকটাই আমাদের বাংলার মতো। সে কারণেই এসব সাহিত্যের নানান পংক্তি আমাদের ভাষাতেও ব্যবহৃত হয় প্রবাদ-প্রবচনরূপে, যেমন- ‘শিশু কান্দে ওদনের তরে’, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ ইত্যাদি।


বাংলা ভাষার আধুনিক কাল বলতে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ থেকে আজ পর্যন্ত সময়কে ধরা হয়। অন্ত্য-মধ্য স্তরের ভাষার সঙ্গে আধুনিক বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড়ো ফারাক সৃষ্টি হয়েছে গদ্যরীতির ব্যবহারে। অন্ত্য-মধ্যযুগে বাংলা গদ্যের ব্যবহার ছিল না এমন নয়, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ প্রভৃতিতেই গদ্যের প্রয়োগ সীমিত ছিল। আধুনিক যুগেই প্রতিষ্ঠিত হল সাহিত্যিক গদ্য। আবার, এ ঘটনার পাশাপাশি আধুনিক বাংলাতেই মুখের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা পৃথক হয়ে যায়। লেখার ভাষার সাহিত্যিক রূপটি ‘সাধুভাষা’ নামে পরিচিত হয়। অন্যদিকে, স্বরসংগতির প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা দেওয়ায় তা মুখের ভাষা এবং চলিতভাষায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়।


এই বিবর্তনপথেই ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্যগুলি। এর ফলে একই ভাষার নানান রূপ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এইভাবেই ভাষা বহতা নদীর মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদল করতে করতে এগিয়ে চলে। আজকের ভাষাও পালটে যাবে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। তখন শুরু হবে বাংলা ভাষার আরেক অধ্যায়।


সংস্কৃত ভাষাকে অনেকেই মনে করেন বাংলা ভাষার জননী। কিন্তু এ মত কি গ্রহণযোগ্য?

কিন্তু সূক্ষ্ম ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে দুটি দিক থেকে বলা যায় যে সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননীস্বরূপা নয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীন মার্জিত সাহিত্যিক রূপ বৈদিক সাহিত্য এবং অর্বাচীন মার্জিত সাহিত্যিক রূপ ধ্রুপদী সংস্কৃত। এই ধ্রুপদী বা লৌকিক সংস্কৃত বিবর্তিত হয়নি, এর কথ্যরূপটি থেকেই এসেছে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার স্তর। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত বৈদিক ভাষা তিনটি ধারায় বিবর্তিত হয়-সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি। এই প্রাকৃত থেকেই দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষার সৃষ্টি। আসলে প্রাকৃত ছাড়া সংস্কৃত ও পালি দুটিই সাহিত্যিক ভাষা, ফলে এই দুই ভাষার বিবর্তনের সম্ভাবনাও কম।


সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে-ভাবে এই বিষয়টি দেখিয়েছেন তা হল-


প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে মধ্য ভারতীয় আর্যের মাগধী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ, মাগধী অপভ্রংশ থেকে অবহট্‌ঠ এবং তা থেকে বাংলার জন্ম। এখন এই পরম্পরায় মাগধী অপভ্রংশ বা অবহটঠের কোনো নিদর্শন পাওয়া না গেলেও এবং অনুমিত হলেও এই স্তরপরম্পরা যুক্তিগ্রাহ্য। সুনীতিকুমার ও সুকুমার সেন অনুসরণে বলা যায় মাগধী অপভ্রংশ হল বাংলা ভাষার জননী। সংস্কৃতর সঙ্গে বাংলার যোগ বহুদূরবর্তী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষায় সংস্কৃত বাংলা ভাষার ‘অতি-অতি-অতি-অতি-অতিবৃদ্ধ পিতামহী।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top