ভাবার্থ লিখন | ভাবার্থ লেখার নিয়ম | ভাবার্থ লেখার কৌশল | ভাবার্থ লিখনের নমুনা | banglasahayak.com

        




ভাবার্থ  লিখন :


গদ্য ও পদ্য রচনায় কোনো না কোনো অন্তনির্হিত মূল ভাব থাকে।সহজ ও সাবলীল ভাষায় সংক্ষেপে তা লেখার নাম ভাবার্থ । অনুচ্ছেদ আকারে প্রদত্ত পদ্যাংশ বা গদ্যংশের মূলভাবকে সহজ,সরল ও প্র্রাঞ্জল ভাষায় সংক্ষেপে প্রকাশ করার বিশেষ রীতিকে ভাবার্থ লিখন বলা হয় ।


ভাবার্থ লেখার ক্ষেত্রে নির্দেশনা :


ভাবার্থ লেখার দক্ষতা অর্জন করতে হলে নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়। চর্চা যতই বেশি হয় ততই শিক্ষার্থীর পক্ষে রচনার মূল ভাববস্তু উপলব্ধির ক্ষমতা ও রচনা নৈপুণ্য বাড়ে। ভাবার্থ লেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত দিকগুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখা দরকার :

পঠন :

ভাবার্থ লিখতে গেলে পদ্যাংশের বা গদ্যংশের তথ্য লিখলে চলে না,মূল ভাব বুঝে নিয়ে তাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করতে হয়।তাই প্রথমে মূলভাব বোঝার জন্য রচনাটি ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়া দরকার।

মূলভাব সন্ধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ 
চিহ্নিতকরণ:


পদত্ত রচনাংশে সাধারণত একটি মূল ভাব বা বক্তব্য থাকে।কখনো কখনো একাধিক মূলভাব বা বক্তব্যও থাকতে পারে।তা উপলব্ধি করতে পারলে ভাবার্থ লেখা সহজ হয়।মূলভাব খুঁজে নেওয়ার একটা সহজ উপায় হল,যেসব বাক্য বা বাকাংশ মূল ভাবের দ্যোতক বলে মনে হয় সেগুলো চিহ্নিত করা।

বাহুল্য বর্জন:


অপ্রয়োজনীয় অংশ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ আলাদা করার মাধ্যমে সহজ মূলভাব বের করা হয়।এজন্য মূল রচনাংশে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি,বর্ণনা, সংলাপ, উহদারণ,অলংকার(উপমা–রূপক)ইত্যাদি বাদ দিতে হয়।

ভিন্নতর প্রসঙ্গের অবতারণা না করা :


ভাবার্থ অবশ্যই মূল রচনার ভাবধারণার মধ্যে সীমিত থাকে।তাই মূলভাবের মধ্যে বাইরে অন্য কোন ব্যক্তিগত মতামত বা মন্তব্য ভাবার্থে প্রকাশ করা চলে না।

ভাবার্থ রচনার কৌশল :

ক. অনুচ্ছেদ :


ভাবার্থ একটি অনুচ্ছেদে লেখা উচিত।

খ. প্রারম্ভিক বাক্য:


প্রারম্ভিক বাক্য যথাযথ সংযত বা আকর্ষণীয় হওয়া চাই।এতে পাঠক বা পরীক্ষক শুরুতেই চমৎকৃত হন।

গ. প্রসঙ্গ বাক্য :


প্রসঙ্গ বাক্য(মূল ভাবটুকু প্রকাশের চুম্বক বাক্য)ভাবার্থের প্রথমে থাকলে ভালো।তা প্রয়োজনে মধ্যে কিংবা শেষে ও থাকতে পারে।

ঘ. প্রত্যক্ষ উক্তি:


মূলে প্রত্যক্ষ উক্তি থাকলে তা পরোক্ষ উক্তিতে সংক্ষেপে প্রকাশ করতে হয়।

ঙ. পুরুষ:


ভাবার্থে উত্তম পুরুষে(আমি,আমরা)বা মধ্যম পুরুষে(তুমি,তোমরা)লেখা চলে না।

চ. উদ্ধৃতি:


মূলে কোন উদ্ধৃতাংশ থাকলে ভাবার্থে উদ্ধৃতিচিহ্ন বর্জিত হবে এবং সংক্ষিপ্ত ও সংহতরুপে তা প্রকাশ করতে হবে।

ছ. ভাষা:


ভাবার্থের ভাষা সরল ও সাবলীল হওয়া দরকার।তাই জটিল বাক্যের পরিবর্তে সরল বাক্য এবং দূরুহ শব্দের পরিবর্তে সহজ-সরল শব্দ ব্যবহার করা উচিত।

জ. হুবহু উদ্ধৃতি বা অনুকৃতি:
মূলের কোন অংশে হুবহু উদ্ধৃতি বা অনুকৃতি ভাবার্থে গ্রহণীয় নয়।মূলত কোন অংশকে সামান্য রদ-বদল করে লিখে দেওয়াও উচিত।

ঝ. পরিসর :


ভাবার্থ কত বড় বা ছোট হবে তা নির্ভর করে প্রদত্ত অংশে বর্ণিত বিষয়ের গুরুত্ব ও গভীরতার উপর।প্রদত্ত রচনার ভাববস্তু সুসংহত ও নিরেট ভাবে প্রকাশিত হলে তা সংক্ষেপ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।ফলে ভাবার্থ মূলের সমান,অর্ধে,এক তৃতীয়াংশ বা তার কম হতে পারে।

ঞ. খসড়া:


ভাবার্থ লিখন লেখার জন্য প্রথমে প্রদত্ত রচনার মূল ভাবটুকুর আলোকে একটি প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করানো ভালো । তারপর প্রয়োজনমত পরিমার্জনা করে পুনর্লিখন করতে হয় ।


কয়েকটি ভাবার্থের নমুনা :

১.  অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাঁদের হৃদয়।


ভাবার্থ :
সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে ভুলে ক্ষমতার লোভে কিছু মানুষের করায়ত্বের কারণে আধুনিক পৃথিবী আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। অথচ যে মহৎ মানুষগুলোর অন্তরে মানুষকে ভালোবাসা তথা দেশপ্রেমের এক সহজাত অনুভব, উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে আছে তারা আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত।


২. আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে-
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’-
সুন্দর হল সে।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা।
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।


ভাবার্থ :
মানুষ সুন্দরের পূজারী। কারণ সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে মানুষ পৃথিবীকে নতুন করে ভালোবাসে। তাই পৃথিবীর সৌন্দর্য ও ভালোবাসা সত্য এবং শ্রেষ্ঠ।


৩.  আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।


ভাবার্থ :
আঠারো বছর বয়সের ধর্মই হলো মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আঘাত-সংঘাতের মধ্যে রক্তশপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এ বয়সই অদম্য দুঃসাহসে সকল বাধা-বিপদকে পেরিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই সঙ্গে নব সৃষ্টির উল্লাসে মাতোয়ারা থাকে।


৪. কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টের করব মোরা পরিহাস।
রিক্ত যারা সর্বহারা, সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,
গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।
আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি।
আমরা দুঃখের বক্রমুখের চক্র দেখে ভয় না করি।
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য,
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীলাকাশ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।।


ভাবার্থ :
মানবজীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী তেমনি সংগ্রামমুখর। এই সংগ্রামে সুখের সঙ্গে দুঃখ কষ্ট বিদ্যমান। তাই দুঃখের সময় হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। বরং সকল দুঃখ-কষ্ট, প্রতিকূলতা জয় করে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।


৫. কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই, আকাশপাতাল জুড়ে
কে তুমি ফিরিছ বন জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিককে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।
ইচ্ছা-অন্ধ। আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ কায়া,
দেখিবে তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি,
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।


ভাবার্থ :
বিধাতাকে পাওয়ার জন্য মানুষ সংসার ত্যাগ করে বৈরাগী হতে চায়। কিন্তু স্রষ্টা তার সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজমান। তাই অন্তর্দৃষ্টি খুলে নিজেকে জানার মাধ্যমেই বিধাতাকে খুজে পাওয়া যায়।


৬. কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।


ভাবার্থ :
স্বর্গ ও নরক দূরে কোথাও নয়, মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। নিজের কর্মফলের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বর্গ ও নরকের ফল ভোগ করে। যারা বিবেকবর্জিত অন্যায় করে বেড়ায় তারা পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রণার ফল ভোগ করে। পক্ষান্তরে যারা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে তারা পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ লাভ করে।


৭. ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।
তোমার আদেশ, যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য জ্বলি উঠে খর খড়গ সম।
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।


ভাবার্থ :
  ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও তা যেন সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। যদি হয় তাহলে সেখানে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এজন্য অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় না দেওয়াই উত্তম। কেননা, অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী দুজনেই সমঅপরাধী।


৮. ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল,
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্তে নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
গড়ে যুগ যুগান্তর-অনন্ত মহান।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি, ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপপথে, ঘটায় প্রমাদ।
প্রিত করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
এ ধারায় স্বর্গসুখ নিত্য দেয় আনি।


ভাবার্থ :
ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা নিয়ে গড়ে ওঠে মহাদেশ, বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে মহাসাগর, তুচ্ছ মুহূর্ত নিয়ে যুগ যুগান্তর। আবার ছোট অপরাধ থেকেই সংঘটিত হয় বড় পাপ।


৯. দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নব সভ্যতা। হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন, পুণ্যছায়া রাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবার-ধান্যের মুষ্ঠি বল্কল-বসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন,
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব,
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব।
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার;
পরানে স্পর্শিতে চাইছিড়িঁয়া বন্ধন,
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।


ভাবার্থ :
নাগরিক সভ্যতা কেড়ে নিয়েছে মানুষের অরণ্য লালিত স্নিগ্ধ জীবনকে। ভোগ, বাসনায় পরিপূর্ণ নগরে আধুনিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকলেও নেই প্রাণের উচ্ছ্বাস। যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে মানবিকতা, সহমর্মিতা, জীবনের সৌন্দর্য। তাই মানুষ আজ সে আরণ্যক জীবন ফিরে পেতে চায়।


১০. বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।


ভাবার্থ :
  মানুষ বহু অর্থ ব্যয় করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় পাহাড়, সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অথচ তার ঘরের পাশেই রয়েছে ধানের শীষের ওপর শিশির বিন্দুর মতো প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যময় রূপ। এই সৌন্দর্যকে উপভোগ না করে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো অর্থহীন।


১১. বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তবু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারি এককোণ।
সে ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।


ভাবার্থ :
এ পৃথিবী যেমন আয়তনে বিশাল তেমনি এর রূপও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু তার বেশিরভাগই মানুষের অজানা। অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরকালের। তাই সে তার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে ভ্রমণকাহিনী পাঠ করে। এর মাধ্যমেই সে তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চায়, তার দীনতাকে ঘোচাতে চায়।


১২. বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্ছনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।


ভাবার্থ :
বিপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজন সাহস, শক্তি আর মনের দৃঢ়তা। অনেক সময় দুঃখ, বঞ্চনায় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু করুণা শিক্ষা নয়, সৃষ্টিকর্তা যেন সকল পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সাহস আর শক্তি মানুষকে দেন এটাই হওয়া উচিত মানুষের প্রার্থনা।


১৩. বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারংবার
তোমা অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা বর্ণ গন্ধময়। প্রদীপের মতো।
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়।


ভাবার্থ : 
সংসারী মানুষ সংসারের মায়া-মমতা, বন্ধনের মধ্যে থেকেই ঈশ্বরের আরাধনা করতে চান। সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে তিনি বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করতে চান না। সংসারই তার কাছে তীর্থস্থান। এ সংসার তীর্থে থেকেই তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে চান।


১৪. মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে, এই পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের লেখা চিরতরঙ্গিত
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময়,
মানবের সুখে-দুঃখে গাহিয়া সঙ্গীত
যদি গো রচিতে পারি অমর আলয়।


ভাবার্থ :
মানুষ জানে সে অমর নয়। এই নির্মম সত্য জেনেও সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। মানুষ হৃদয়ের মাঝে চির অমরত্ব লাভ করতে চায়। পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে, মহৎ কীর্তি স্থাপন করার মাধ্যমেই কেবল মানুষ পারে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে।


১৫. যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে।
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
সর্বজন সর্বক্ষণ চলে সেই পথে
তৃণ গুল্ম সেথা নাহি জন্মে কোন মতে।
যে জাতি চলে না কভু, তারি পথ পরে
তন্ত্র-মন্ত্র-সংহিতায় চরণ না সরে।


ভাবার্থ :
গতিই জীবনের মূলকথা। স্রোতহীন নদী যেমন শৈবালের কারণে আরো মন্থর হয়ে যায় তেমনিভাবে গতিহীন জাতির হৃদয়ে নানা লোকাচার বাসা বাঁধে। এর ফলে সে জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং গতিময়তার মধ্যেই সভ্যতার উৎকর্ষ নিহিত।



১৬. পৃথিবীতে যাহার দিকে তাকাও, দেখিবে-সে নিজের অবস্থায় সন্তুষ্ট নহে। দরিদ্র কী প্রকারে ধনী হইবে, সে চিন্তায় উদবিগ্ন, ধনী চোর ডাকাতের ভয়ে ত্রস্ত। রাজা শত্রুর ভয়ে ভীত। এক কথায় পৃথিবীতে এমন কেহ নাই যে পূর্ণ সুখে সুখী অথচ কৌতুকের বিষয়-পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতে কেহ প্রস্তুত নহে। মৃত্যুর নাম শুনিলেই দেখি মানুষের মুখ শুকাইয়া যায়। মানুষ যতই দরিদ্র হউক, সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাহাকে অনাহারে কাল কাটাইতে হয়, পৃথিবীর কোনো আরামই যদি তাহার ভাগ্যে নাও থাকে তথাপি সে মৃত্যুকে চাহে না। সে যদি কঠিন পীড়ায় পীড়িত হয়, যদি শয্যা হইতে উঠিবার শক্তিও তাহার না থাকে, তথাপি সে মৃত্যুর প্রার্থী হইবে না।

ভাবার্থ : মানুষ জন্মাবধিই দুরন্ত আশাবাদী, সর্বদাই সে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর। সংসারের সকল মানুষই তার বর্তমান অবস্থায় বিরূপ এবং এস্ত। এই অবস্থার শিকার ধনী নির্ধন সব মানুষ। সুখ আন্তর উপলব্ধি। কিন্তু বহিরঙ্গের প্রতি অন্ধ আকর্ষণ সততই মানুষের অন্তরকে অসুখী করে তোলে। তবুও বিস্ময় এই যে বর্তমান অবস্থায় অসন্তুষ্ট হয়েও কেউই মৃত্যু-কামনা করে না। সুখী জীবনের প্রতি দুর্নিবার ও সম্পূহ ব্যাকুলতাই মানুষকে মৃত্যু সম্পর্কে বিমুখ করে রাখে।

১৭. জন্মদিনের পরও জন্মদিন ফুরোয় না, রোজই তাঁর জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ রোজই। প্রতিদিন প্রতিনিয়তই তাঁর সঙ্গে আমাদের চলাফেরা মেলামেশা। আমাদের হাতের লেখা রবি ঠাকুরের। কথা বলার ভাষা রবি ঠাকুরের। পরীক্ষার খাতায় রবি ঠাকুর। আমাদের গভীর আনন্দ অথবা গোপন ব্যথার গান রবি ঠাকুরের। স্বদেশকে চোখের দৃষ্টি করে রাখার জাতীয়তাবাদ রবি ঠাকুরের। বিদেশকে চোখের সামনে দৃষ্টান্ত করে রাখার আন্তর্জাতিকতা রবি ঠাকুরের। আকাশে, মাটিতে, মনে এত যে বৃষ্টি পড়ে, তার ছন্দ রবি ঠাকুরের। এত যে ফুল ফোটে তার গন্ধ, রবি ঠাকুরের। তাই প্রতিদিনই তাঁর জন্ম। কোনোদিনই মৃত্যু নেই। কালের কালাপাহাড় এসে ভারতবর্ষ থেকে কোনোদিন সমস্ত ঠাকুরের পুজোর প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে যায় যদি, তবু একটি ঠাকুরের বেদী চিরকাল থাকবে মাটির সঙ্গে গাঁথা। কোন্ ঠাকুর? রবি ঠাকুর।

ভাবার্থ :  বাংলার মানুষের নান্দনিক চেতনার সঙ্গে একটি নাম একাত্ম হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথই সেই নাম। প্রতিদিনই নানা রূপে, সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় তিনি যেন নব নব রূপে মূর্ত হয়ে উঠেছেন। আমাদের লেখাপড়া, কাব্য, ছন্দ, সংগীত, স্বদেশচিন্তা, এমনকি ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার নানা বিচিত্র অনুভবের টানাপোড়েনে যেন তিনিই উপস্থিত। তাঁর অবদান যেন প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি করে অনুভূত হয়। বাংলার সংস্কৃতির অন্য যে-কোনো ধারার অবলুপ্তি ঘটতে পারে, কিন্তু যে নাম সর্বদাই মনে মনে উচ্চারিত হবে তা রবীন্দ্রনাথের নাম।


0 thoughts on “ভাবার্থ লিখন | ভাবার্থ লেখার নিয়ম | ভাবার্থ লেখার কৌশল | ভাবার্থ লিখনের নমুনা | banglasahayak.com”

  1. নামহীন

    তবু ভরিল না চিত্ত। ঘুরিয়া ঘুরিয়া কত তীর্থ হেরিলাম, বন্দিনু পলকে বৈদ্যনাথ, সুঙ্গেরের সীতাকুন্ডে গিয়া কাঁদিলাম চিরদুঃখী জনকীর সুখে, হেরিনু বিন্ধ্যাবাসীনি বিন্ধ্যে আরোহিয়া; করিলাম কত নৃত্য, প্রফুল্ল আশ্রমে, রআধআশ্যআমএ নইরখইয়আ হইয়া উতলা গীতগোবিন্দের শ্লোক গাহিয়া গাহিয়া ভ্রমিলাম কুঞ্জে কুঞ্জে, পান্ডারা আসিয়া গলে পরাইয়া দিলো বরগুঞ্জমালা। তবু ভলিরো না চিত্ত। সর্বতীর্থসার তাই মা, তোমার পাশে এসেছি আবার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top